আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে উত্থাল ঢাকা। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার ঘটনায় সংক্ষুব্ধ নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তার ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে যমুনার সামনে যে কর্মসূচির ডাক দেন, তা অবশ্য শুক্রবার সকালে যমুনার অদূরে রাজধানীর মিন্টু রোডের মুখে ফোয়ারার সামনে সরে আসে এবং সেখানে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়।শনিবারও সকাল থেকে চলছে কর্মসূচি। কিছুদিন ধরে এনসিপির সভা-সভাবেশে যে ভাটার টান লেগেছিল, এই কর্মসূচিতে তার বিপরীত দৃশ্য দেখে এনসিপির নেতাকর্মীরা হয়তো উচ্ছ্বসিত হতে পারেন। শুক্র ও শনিবার দুদিনই বহু মানুষের আনাগোনা দেখা গেছে তাদের কর্মসূচিতে।

কে আসেনি? জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, লেবার পার্টি, জাগপা ও ইনকিলাব মঞ্চের নাম পাওয়া যায় সংবাদমাধ্যমে। তবে বিক্ষোভ কর্মসূচিটা এনসিপির নয়, এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ আহুত।

শুক্রবার সকালে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে বেশ জোরালো বক্তব্যই রেখেছেন।ব্রিটিশ ভারত থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত– চার দফা নিষিদ্ধ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে যে জামায়াতে ইসলামীর শুক্রবার সকালে সেই দলটির নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ ‘দুপুরের আগেই সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে’ বলে দাবি করেছিলেন। গেল বছর ১ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকার যখন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল ততদিনে জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নিয়েছে। এবার অবশ্য জামায়াতে ইসলামীকে বেশি দিন নিষিদ্ধ থাকতে হয়নি, অন্তর্বর্তী সরকার নিষেধাজ্ঞাটি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৮ অগাস্ট। কিন্তু এর আগেই ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের পর সরকারিভাবে নিষিদ্ধ জামায়াত নেতাদেরই তৎকালীন পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময়ের জন্য ডেকে এনেছিলেন সেনাপ্রধান।

জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা অনুচিত হয়েছিল।এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাটা কি খুব উচিত কাজ হবে? গণহত্যার দায় তো এই দুটি দলেরই রয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপের শুরুতেই বলে রাখি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ নামক দলটির প্রতি আমার ন্যূনতম অনুরাগ নেই। বিরাগের অনেক কারণ রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিরুদ্ধমতের অনুসারী হওয়ার কারণে আমাকে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নির্যাতন সইতে হয়েছে। তাদের নির্যাতন-নিপীড়র থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য হল ছেড়ে আসতে হয়েছিল আমার। আমাদের মতো গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে আসা নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের হলে কম খরচে খাওয়া-থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তা-ও তো আমি বেঁচেবর্তে আছি, বুয়েটের আবরার ফাহাদের মতো প্রাণ দিতে হয়নি।

আমাদের তারুণ্যের প্রাণোচ্ছ্বল দিনগুলো কেটেছে ভয়াবহ দুঃশাসনের মধ্যে। গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা। আমরা বড় হয়েছি, ২০১৪ সালের ‘একতরফা নির্বাচন’, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ‘আমি আর ডামির নির্বাচন’ দেখে। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারিনি একবারও। বিগত দেড় দশক ধরে দেখেছি শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র ঘটনা। এই সব কিছুর বিপরীতে বারবার আমাদের উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছেন হাসিনা ও তার সরকারের হর্তাকর্তারা, যারা বিদেশী ঋণের বোঝায় জর্জরিত উন্নয়ন থেকে লুটেপুটে ধনকুবের বনেছেন। ব্যাংকগুলোকে ছিবড়ে খেয়েছেন তারা। এরপর শুনেছি শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’র মতো লাগামহীন গালি।

পতন অনিবার্য ছিল শেখ হাসিনার। সন্দেহাতীতভাবে এই পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা। আন্দোলন চলাকালে যে ছাত্রদের আমরা নেতা হিসেবে দেখতে পেলাম, জুলাইয়ের আগে তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকজন চিনত না। বিশ্ববিদ্যালয়েরও খুব বেশি শিক্ষার্থী চিনত বলে মনে হয় না। জুলাই অভ্যুত্থানের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসাবে একথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে এই আন্দোলন ছিল আপামর জনগণের– কোনো একজন বা কয়েকজন নেতার অবদান বলে ভাবলে ভুল করা হবে। দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বিএনপির রয়েছে সবচেয়ে বড় ভূমিকা। ভূমিকা রেখেছে জামায়াতে ইসলামীও। সেটা স্বয়ং শেখ হাসিনাও জানতেন। আর জানতেন বলেই গত বছর ১ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান যখন তুঙ্গে তখন এক নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। পারলে বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করতেন। বিএনপির মতো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি দলকে নিষিদ্ধ করতে গেলে বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হতেন, তাই পারেননি। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পেরেছিলেন দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায় রয়েছে বলে।

বিএনপি তো বটেই, জামায়াতে ইসলামীও গণঅভ্যুত্থানে বিজয় অর্জনের পর কৃতিত্ব দাবি করতে যায়নি।তবে এই মুহূর্তে শাহবাগকেন্দ্রিক যে আন্দোলন চলছে, জামায়াতে ইসলামী তার কলকাঠি নাড়ছে। লেখক-সাংবাদিক এহসান মাহমুদ লিখেছেন, “গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যেটা আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে শাহবাগের জমায়েত থেকে স্লোগান এসেছে- নিজামীর বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই। স্লোগান এসেছে- গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই।” গণঅভ্যুত্থানে কৃতিত্ব এককভাবে এনসিপিও দাবি করতে পারে না, আবার গণঅভ্যুত্থানকে কোনো দল ও গোষ্ঠীর হাতে তুলেও দিতে পারে না তারা। মানছি এই দলটি যাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে তাদের বেশির ভাগই গত বছর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তুখোড় সব ছাত্রনেতা। কিন্তু ওই গণঅভ্যুত্থানের সব নেতা ওই দলে যোগ দেননি। মিছিলের বহু চেনা মুখকে এখন প্রত্যেক দিন দলটিকে নিয়ে সমালোচনা করতে দেখছি, বিশেষ করে সেই মেয়েদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখছি, আন্দোলনের সম্মুখসারিতে যাদের প্রবল উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে থমকে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে বরাবরই নতুন দলের জন্ম হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিংস পার্টি বলে পরিচিত এনসিপি বাদে আরও যে সব নতুন পার্টির জন্ম হয়েছে, সেগুলোর দুটি ‘বাংলাদেশ আ-আম জনতার পার্টি’ ও ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’। প্রথমটিকে কিছু মানুষ মনে রেখেছে অদ্ভুত নামের জন্য, দ্বিতীয়টিকে দলের প্রধান নেতা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’খ্যাত নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে চিনে বলে। এই সময়ে জন্ম নেওয়া অন্য সব পার্টির নাম মানুষের কাছেই পৌঁছাতে পারেনি, যেমন ‘বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি’।

নতুন এই দলগুলোর মধ্যে এনসিপি ছাড়া আলোচনায় আর কেউ নেই। অবশ্য এনসিপিও গুরুত্ব হারাতে বসেছিল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি হয়তো তাদের নতুন করে একটা সুযোগ এনে দিতে পারত, যা চোরাগলিতে মুখ গুঁজতে চলেছে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভরতদের দাবদাহ থেকে প্রশান্তি দিতে শুক্রবার দুপুরে মিন্টো রোডে সিটি করপোরেশনের গাড়ি থেকে শীতল পানি ছিটানো হয়। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মাঠে যারা মাঠে নেমেছে তাদের লক্ষ্য নিয়ে জনমনে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা চলছে বিক্ষোভ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পাশ দিয়ে হাঁটাচলা করা যেখানে কঠিন সেখানে ব্যাপক আদর-আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে এক রাত আন্দোলন করেছেন তারা।এর মধ্যে শুক্রবার ফোয়ারা হয়ে শনিবার এসে মিলিত হয়েছেন শাহবাগে। গরম থেকে বিক্ষোভকারীদের প্রশান্তি দেওয়ার জন্য শুক্রবার বিক্ষোভস্থলে সিটি করপোরেশনকে ঠাণ্ডা পানি ছিটাতে দেখা গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করেছে ঢাকা ওয়াসা। এখন শাহবাগেও বিশেষ যত্নে আছেন দেখতে পাচ্ছি, যেমনটা ২০১৩ সালে ঘটেছিল শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের সময়।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোনো গুরুত্বই নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালাতে না দিলে এবং তারপর আবার নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করা না হলে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তৈরি করা যেত না। আবদুল হামিদকে পালাতে দিল কারা? হঠাৎ করে এতদিন পর সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করার প্রয়োজন হলো কেন?

আওয়ামী লীগ এখন কারও প্রতিপক্ষ নয়, অন্তত ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই দলটি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটেনি। এনসিপি নেতাদের হয়তো ভয় পাওয়ার কিছু কারণ রয়েছে, তারা ভাবতে পারেন আওয়ামী লীগ কোনোভাবে ফিরে আসতে পারলে তাদের রেহাই মিলবে না। কিন্তু এনসিপিরও জানা আছে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা সুদূরপরাহত। প্রকৃতপক্ষে এনসিপি এবং তাদের পেছনে এসে গত দুদিন যারা দাঁড়িয়েছে, তারা সবাই প্রধান প্রতিপক্ষ বিবেচনা করছে বিএনপিকে। চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসায় বিএনপি এখন দারুণ উজ্জীবিত। তারেক রহমানের দেশে ফেরাও সময়ের ব্যাপার বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ফলে আগামী নির্বাচনে বিএনপির জয় ঠেকাবার কোনো উপায় নেই। এই আতঙ্ক থেকেই অবশিষ্ট সব দল এনসিপিকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে মাঠে নেমে এসেছে, আসলে নির্বাচনকে ঠেকাবার, নিদেনপক্ষে বিলম্বিত করার লক্ষ্যে।

আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। জুলাই অভ্যুত্থানে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার এই পাপের ফল দলগতভাবেও তাদের বহন করতে হচ্ছে। হবে আরও অনেকদিন। ফলে দলটি নিষিদ্ধ হলে আমি ব্যথিত হব না। তবে গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে বলে মনে করি।

ক্ষতিটা অবশ্য খোদ দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই করে গিয়েছিলেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে। খেয়াল করবেন আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলেছি। এককভাবে দলটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কারোর নাম বলতে গেলে অবশ্য মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম বলতে হবে।

গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ‘আওয়ামীলীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮ -১৯৭০’ বইয়ে দলটির জন্মলগ্নের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে মুসলিম লীগ বেরিয়ে এসে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এটি আওয়ামী লীগের আদি সংগঠন, যা পরে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগের যে কাউন্সিল হয়, সেখানে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। এটিও করা হয়েছিল মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগেই।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর মওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেয়া হয় একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করার জন্য। তিনি অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন। সেই নতুন কমিটির সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী। সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান। সাধারণ সম্পাদক হলেন শামসুল হক। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান, যার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ গঠনের প্রথম সভার আয়োজন হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

প্রতিষ্ঠালগ্নে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বেশ পেছনের সারির একজন নেতা। অথচ শেখ হাসিনার চার দফার শাসনামলে ইতিহাসকে করা হয়েছে মুজিবময়। যেন ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ কোথাও আর কেউ ছিলেন না। যে মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল, সেই দলটির কথা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কয়জনের জানা আছে? হয়তো একদিন আওয়ামী লীগেরও দশা হবে মুসলিম লীগের মতোই।

আওয়ামী লীগের সমর্থক বা ভোটার কারা? তাদের সংখ্যাই বা কত? আর আওয়ামী ভোটারদের অন্য দলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বা কতটুকু? অনেকেই মনে করেন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যেই রয়েছে আওয়ামী লীগের একমাত্র ভোট ব্যাংক। সুফি ঘরানা ও মাজারপন্থী মুসলিমদেরও অনেকেই আওয়ামী ভোট ব্যাংকের অংশ। বামধারার সাধারণ লোকজন তো বটেই, প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী রাজনীতি করেন এমন অনেকেই ভোটের সময় আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার, কেন্দ্র থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত দলটির বিভিন্ন ইউনিটের কমিটির সঙ্গে আছে লক্ষ-কোটি সমর্থক। দেশের ইতিহাসে, ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে এরকম চারটি নির্বাচন বিশ্লেষ করলে দেখা যায়–

প্রাপ্ত আসন সংখ্যা

প্রাপ্ত ভোট (শতকরা)

নির্বাচনের তারিখ

সংগৃহীত ভোট

বিএনপি

আওয়ামী লীগ

জামায়াত

বিএনপি

আওয়ামী লীগ

জামায়াত

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

৫৫.৫ শতাংশ

১৪০

৮৮

১৮

৩০.৮ শতাংশ

৩০.১ শতাংশ

১২.১ শতাংশ

১২ জুন ১৯৯৬

৭৫.০ শতাংশ

১১৬

১৪৬

৩৩.৬ শতাংশ

৩৭.৫ শতাংশ

৮.৬ শতাংশ

০১ অক্টোবর ২০০১

৭৫.৬ শতাংশ

১৯৩

৬২

১৭

৪১.০ শতাংশ

৪০.১ শতাংশ

৪.৩ শতাংশ

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮

৮৭.১ শতাংশ

৩০

২৩০

৩২.৫ শতাংশ

৪৮.০ শতাংশ

৪.৭ শতাংশ

সূত্র: বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন

আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালে সর্বনিম্ন ৩০.১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৮.০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আবার, বিএনপি ১৯৯১ সর্বনিম্ন ৩০.৮ শতাংশ এবং ২০০১ সালে সর্বোচ্চ ৪১.০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।যে বিএনপি ২০০১ সালে সর্বোচ্চ আসন (১৯৩) পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল, সেই বিএনপি দুর্নীতি, বাংলাভাইদের উৎপত্তি ও বিদ্যুৎ ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে সর্বনিম্ন ৩০ আসনের লজ্জায় লজ্জিত হয়েছিল। আবার, মূলধারার আলেমদের সঙ্গে ইসলামী আকিদাগত বিতর্ক, ধর্মের নামে উগ্র চিন্তা লালন, ৭১-এর অপরাধের জন্য ক্ষমা না চাওয়াসহ বিবিধ কারণে জামায়াতের ভোট ১৯৯১ সালে ১২.১ শতাংশ থেকে কমে ২০০৮ সালে ৪.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, যে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ আসন ২৩০ পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগ ভোট জালিয়াতি, অর্থ-পাচার, গুম-খুন, দুর্নীতি ও ভিন্নমতের দমনসহ নানাবিধ কারণে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। যাই হোক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক থাকলেও, মূলত আমজনতার ভাসমান ভোটগুলোই নির্বাচনের জয়-পরাজয় নিশ্চিত করে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, গত ১৫ বছরের ভয়াল রূপের আওয়ামী লীগেকে তো বাংলাদেশ আগে কখনও দেখেনি। আবার যে তরুণরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগেকে লাল কার্ড দেখাল এবং যাদেরকে দেড় যুগ ধরে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো, সেই বিপুল সংখ্যক তরুণ ভোটার কি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? এটা সত্য যে তরুণ ভোটার, গত ১৫ বছরের দমন-নিপীড়নের কারণে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই বেশ ভালো সংখ্যক ভোটার হারিয়েছে। তবুও, তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমর্থক এখনও আছে এবং এই সংখ্যাটি ২০ শতাংশ হতে পারে।

সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে, দলীয় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবেই যদিও দেড় যুগের নির্বাচনবিহীন সংস্কৃতির কারণে আমজনতার একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নেই যে আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট সংগৃহীত হবে, সেটা যদি ২০০৮ সালের নির্বাচনকে ছাড়িয়ে যায় তাহলে ৯০ শতাংশের মতো হওয়ার কথা, ওই নির্বাচনে সংগৃহীত ভোটের পরিমাণ ছিল ৮৭.১ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হলে তাদের সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না। অবশ্য নিষিদ্ধ না করা হলেও দলটি নির্বাচন করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে কিছু আদর্শিক ও দার্শনিক মিল অবশ্যই থাকে। আওয়ামী সমর্থকদের যে নীতি-আদর্শ ও চিন্তা-ফিকির তা কখনোই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে তো মিলবে না। নবগঠিত এনসিপিরও সঙ্গে মিলবে না। কারণ, আওয়ামী লীগ মধ্য-বামপন্থী আর বিএনপি মধ্য-ডানপন্থী দল। এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থী বলে দাবি করলেও তাদেরকে অনেকেই এখনই ডানপন্থী দল বলে ভাবতে শুরু করেছে। সুতরাং, আওয়ামী লীগের মৌলিক ভোটারদের বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

আওয়ামী লীগকে আজকে জোরপূর্বক নিষিদ্ধ করলে, কালকে অন্য নামে নতুন দল করে আবার ফিরে আসবে এবং একই আদর্শের রাজনীতি করবে। আওয়ামী লীগ যদি, আওয়ামী লীগ নামেই রাজনীতি করে, তবে তাকে চিরকাল গনহত্যার কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হবে। আর যদি নতুন রাজনৈতিক দলের নামে করে, তবে তাদের কোন কলঙ্ক থাকবে না। মার্কেটিং এর একটা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব কোনো একটি ব্র্যান্ডের পণ্য সুনাম হারালে ওই পণ্যটিকে ভিন্ন নামে ব্র্যান্ডিং করে ভোক্তার কাছে তুলে ধরতে হয়। ভেতরের পণ্য তো একই, শুধু ওপরের খোলস বা ব্র্যান্ডের নাম বদল করে ভোক্তাকে ধোঁকা দেয়াটাই, এই তত্ত্বের মূল কথা।

যদি মনে করেন, আওয়ামী লীগকে জোর পূর্বক নিষিদ্ধ করবেন এবং ভবিষ্যতে ভিন্ন নামেও রাজনীতি করার সুযোগই দেবেন না, তবে কি আওয়ামী লীগ বসে থাকবে? জামায়াত কি গত ১৫ বছর প্রায় ৫ শতাংশ ভোটার নিয়ে বসে ছিল? উপরন্তু, ভারতের মত এক বিশাল শক্তি আওয়ামী লীগকে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে সর্বত্র সহায়তা করবে। আওয়ামী লীগ ভারতকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণাত্মক বা রক্ষণাত্মক খেলা খেলবে। তারা যদি আক্রমণাত্মক হয় পরিণতি খুবই খারাপ হতে পারে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে কিনা, এমনটা যখন ভাবছিলাম, তখনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের একটি বক্তব্য সামনে এল। শুক্রবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের কার্টার সেন্টারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকরা তাকেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে মঈন খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না, তা বিএনপি নয়, জনগণ ঠিক করবে।’

রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যখন মঈন খান সাংবাদিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন তখন যমুনার সামনে জমে ওঠেছিল এনসিপির বিক্ষোভ। তার কাছে এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এই দাবি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলছে, তারা তাদের বক্তব্যে বলেছে। কাজেই বিএনপি হিসেবে তো আমরা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নই। আমাদের মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) ইতিমধ্যে বলেছেন যে জনগণের সিদ্ধান্তের বিষয় এটা। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কারা নির্বাচন করবে, আর কারা করবে না। এটা হচ্ছে আমাদের (বিএনপির) বক্তব্য।’

বিএনপির এই বক্তব্যটার সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করি। তবে হ্যাঁ, আমি গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বিচার চাই, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সাহস না পায়। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনকে মানুষের কাছে এমনভাবে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করতে হবে যেন আওয়ামী লীগের নাম শুনলেই শেখ হাসিনার রাতের ভোট, অর্থপাচার, সীমান্ত-হত্যা, গণহত্যা, গুমখুন ও আয়নাঘরের মতো বিষয়গুলোর কথা মনে আসে মানুষের।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews