শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শিক্ষার্থী দীর্ঘ ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর সহধর্মিণী ড. ইয়াসমিন হকের অনুরোধে অনশন ভাঙেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক দম্পতি। এ সময় অনশনরত শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে অনশন ভাঙলেও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে মঙ্গলবার ভোর ৪টায় ঢাকা থেকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ক্যাম্পাসে পৌঁছান জাফর ইকবাল দম্পতি। ক্যাম্পাসে পৌঁছার পর ড. জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের অনশন ভাঙার অনুরোধ জানান। একপর্যায়ে অনশনরত শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনশনরত অন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে সকালে অনশন ভাঙার প্রতিশ্রুতি দেন। সকালে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে অনশনস্থলে নিয়ে আসা হয় চিকিৎসারত শিক্ষার্থীদের। পরে সবাইকে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান অধ্যাপক জাফর ইকবাল দম্পতি। এদিকে ভোররাতে ক্যাম্পাসে আসার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ড. ইয়াসমিন হক। তিনি বলেন, ‘আমরা আসার আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জুমে কথা বলেছি। আমরা বলেছিলাম কাল আসব। তারা বলল- না, আপনারা আজই আসেন। তখন আমরা দেরি না করে রাতেই রওনা দিই। ভোরে এসে এখানে পৌঁছি। তারা বলেছিল আমরা এলে তারা অনশন ভাঙবে। তারা তাদের কথা রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাত্রদেরকে অবহেলা করেছেন, ছাত্রদের যে ক্ষোভ আছে তা বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। আজকের এ আন্দোলন তিন বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।’ অনশন ভাঙার পর অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘একটা মানুষের জন্য এত মানুষের জীবন নষ্ট করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। আমি তাদের অনশন ভাঙাতে পেরেছি। তারা আমার কথা রেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘এতগুলো শিক্ষার্থী না খেয়ে মারা যাচ্ছে। তাদের অনশন ভাঙানোই ছিল আমার উদ্দেশ্য। তারা আন্দোলন করবে কি না তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের আন্দোলন যৌক্তিক। আমি এখানে আসতে চাচ্ছিলাম না, কারণ যদি তারা আমার কথা না শোনে। তবে আমার বিশ্বাস ছিল আমি তাদের অনশন না ভাঙিয়ে এখান থেকে যাব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে টং দোকান বন্ধ ও রোড পেইন্টিং নিষিদ্ধ- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যখন থেকে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক তখন থেকেই বুঝতে হবে যে এই উপাচার্য একাডেমিক কিছু বোঝেন না, শিক্ষার কিছু বোঝেন না, ছাত্রদের বোঝেন না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়ার সময় উপাচার্যকে একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে বলেছিলাম এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো উনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।’ অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করি। এ আন্দোলন থামানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো অমানবিক, নিষ্ঠুর ও দানবীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। যেই ভিসির বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন না খেয়ে আছে, তবু ভিসির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তিনি কখনো শিক্ষার্থীদের ভিসি হতে পারেন না।’

আন্দোলনে বহিরাগতদের যোগসাজশ থাকতে পারে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছে তারা একেবারেই সাধারণ শিক্ষার্থী। পুলিশ তাদের ওপর হামলা করায় তারা আন্দোলন করছে। তাদের ওপর যখন পুলিশ হামলা চালিয়েছিল তখন শিক্ষকদের উচিত ছিল ঝাঁপিয়ে পড়া। তারা তা করেননি। এমন আন্দোলন বাইরের মানুষ নিজেদের স্বার্থে নিয়ে নেয়। তোমরা তা হতে দাওনি। আমি বহিরাগত। এর পরও তোমরা যদি আমাকে ডাকো আমি সাড়া দেব।’

এদিকে সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করার ঘটনায় ক্ষোভ জানান ড. জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘ওরা টাকাপয়সা দেওয়ায় গ্রেফতার হয়েছে। তোমাদের সাহায্য করতে যদি অ্যারেস্ট হতে হয় তাহলে আমি হব। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থে আমার কাছে একটা লেখা চেয়েছিল। সেই লেখাটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়েছে। আমি এ সম্মানির টাকাটা নিয়ে এসেছি। শিক্ষার্থী আন্দোলনের ফান্ডে এ টাকা দিচ্ছি। আমি দেখতে চাই সিআইডি আমাকে অ্যারেস্ট করে কি না।’ তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘সরকার থেকে আমাকে কথা দেওয়া হয়েছে সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং কাউকেই হয়রানি করা হবে না।’ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় জাফর ইকবাল বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ২০০ থেকে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যখন প্রয়োজন হবে তখন একজনকে ঢোকানো হবে। আমি আইজিপিকে বলেছি ছাত্রদের বিশ্বাস করুন। ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের মারবেন না। সবার হাতে স্মার্টফোন থাকে একটা ছবি দেখান যে ছাত্ররা গুলি করেছে। এসবের কোনো প্রমাণ নেই।’ মেডিকেল টিম না থাকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা টের পাচ্ছ না যে তোমরা কী করেছ। ৩৪ জন ভিসির ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। তোমরা সারা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নাড়া দিয়েছ। আমি ধরে নিয়েছিলাম অনশনের এখানে মেডিকেল টিম আছে। তারা সার্বক্ষণিক দেখভাল করছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ডাক্তাররা ছিলেন কিন্তু তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনশনকারীদের অবস্থাই যখন এত খারাপ, তাহলে অসুস্থ ২০ জনের কী অবস্থা! আমি শঙ্কিত। এটা চরম অমানবিকতা।’

প্রসঙ্গত, ১৩ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের ছাত্রীরা। এর জেরে ১৬ জানুয়ারি বিকালে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে উপাচার্যকে মুক্ত করে পুলিশ। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্য বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ফলে ১৭ জানুয়ারি থেকে বাসভবনে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। ১৯ জানুয়ারি দুপুরে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী। তাদের একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অনশন শুরুর পরদিনই বাড়ি চলে যান। এর মধ্যে উপাচার্য ইস্যুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ২২ জানুয়ারি রাতে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠকে উপাচার্যের পদত্যাগ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও দাবিগুলো লিখিতভাবে জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে বৈঠকের পর শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের মূল দাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ। এ দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে সরবেন না।

আটক পাঁচজনের জামিন : উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অর্থ প্রদান, চাঁদা দাবি ও আদায় এবং ভয়ভীতি প্রদানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় আটক বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট মহানগর হাকিম দ্বিতীয় আদালতের বিচারক সুমন বড়ুয়া তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। এর আগে সন্ধ্যায় তাদের আদালতে হাজির করা হয়। জামিনপ্রাপ্তরা হলেন- হাবিবুর রহমান খান (২৬), রেজা নুর মুইন (৩১), এ এফ এম নাজমুস সাকিব (৩২), এ কে এম মারুফ হোসেন (২৭) ও ফয়সল আহমেদ (২৭)। তারা সবাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।

রাষ্ট্রপতিকে শিক্ষক নেটওয়ার্কের চিঠি : শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে এর ‘অচলাবস্থা’ নিরসনে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে খোলা চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। গতকাল সংগঠনের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবির সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং আন্দোলনকারীদের হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews