সরাসরি সামরিক যুদ্ধে লিপ্ত দুটি দেশের বিবাদ কোনো দিকে মোড় নেবে সেটির সঠিক অনুমান করা অনেকটা অসম্ভব। কারণ এই লেখা লিখতে লিখতেই বড় দুটি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমত. ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে। দ্বিতীয়ত. এই সম্মতির কয়েকঘণ্টার মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে সেই অস্ত্রবিরতির প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভিযোগ এনেছে। তার অর্থ হলো দুই দেশের অস্ত্রবিরতির এই প্রতিশ্রুতি অনেকটা দুর্বল। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ চলতি যুদ্ধের চেয়ে আরও ভয়াবহ বার্তা দেয়। এই পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াবে কিনা সেই প্রশ্নকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাই বলা যায়, ৭ মে মধ্যরাতে ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ২৫ মিনিটের ‘নির্ভুল’ আক্রমণ পরিচালনা করার মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যে যুদ্ধের শুরু হয় তা এখনও শেষ হয়নি বলা যায়। ‘অপারেশন সিঁদুর’ ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে পরিচালিত ভারতের সবচেয়ে বড় ধরণের আক্রমণ।

এখন প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধ কি অস্ত্রবিরতির প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই শেষ হবে, নাকি এটি কৌশলগত বিরতি মাত্র? সামনে যুদ্ধের হিসাব নিকাশ আরও জটিল হলে এই যুদ্ধ কি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেবে? সেটি হলে সেই আশঙ্কার জোর কতটুকু? নাকি শক্তি পরীক্ষা বা রাজনৈতিক তুষ্টিবাদের এই যুদ্ধ এবারও স্বল্পমেয়াদেই শেষ হবে? ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেই এর আগে প্রকাশিত লেখায় বলেছি যে বর্তমানে এই দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সবশেষ কোথায় যেয়ে থামবে সেটা বলাও কঠিন হবে, কারণ গত কয়েক দশকে দুই দেশের ঘরের রাজনীতির অনুঘটক অনেকটাই বদলে গেছে। একদিকে ভারত যেমন ডেমোক্রেটিক সেক্যুলারিজম থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। একইভাবে গণতন্ত্রহীন পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়েছে অনেক দিন হয়েছে। আর ভারতের জনগণও রাষ্ট্রের মালিকানা হারানোর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ অতীতের যে কোনো ঘটনার চেয়ে আরও বহুগুণ ধ্বংসাত্মক হওয়ার উচ্চঝুঁকি এখনও রয়েছে। কিন্তু সর্বাত্মক-যুদ্ধ ঝুঁকির ভিত্তি কতটুকু শক্ত?

আগে দেখা যাক সর্বাত্মক যুদ্ধ কি এবং কখন দুই বা তার অধিক দেশের মধ্যে এই ধরণের যুদ্ধ হওয়ার বাস্তবতা দেখা দেয়। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান যুদ্ধকৌশল বিষয়ক পণ্ডিত কার্ল ফন ক্লাউজেভিতস (জার্মান উচ্চারণে) প্রথম এই শব্দযুগল ব্যবহার করেন। যাকে ইংরেজিতে ‘অ্যাবসলিউট ওয়ার’ বা ‘টোটাল ওয়ার’ বলা হয়। প্রুশিয়ান এই জেনারেল তার ‘ফম ক্রিগ’ নামক বইয়ে এই শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার করেন। যা ইংরেজি ভাষায় ‘অন ওয়ার’ নামে অনুবাদ করা হয়েছে। এই নামেই বইটি সারাবিশ্বের সমরবিদদের কাছে পরিচিত। ক্লাউজেভিতস মূলত যুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে যুদ্ধের এই প্রকার নির্ধারণ করেন। বিবদমান পক্ষের মধ্যে প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখেই অনুমান করা যায় চলমান যুদ্ধ সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেবে কিনা।

ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর ইসলামাবাদে পাকিস্তানিদের উল্লাস— যা বুঝিয়ে দেয় দেশটির মানুষ সর্বাত্মক যুদ্ধে অনিচ্ছুক। ছবি: রয়টার্স

প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো ‘বিবদমান পক্ষ যুদ্ধে জিততে যা কিছু প্রয়োজন সেটি উৎসর্গ করতে প্রস্তুত কিনা’। যেমন, জান-মাল বা অন্য যা কিছু প্রয়োজন হোক না কেন সেই সবের বিনিময়ে বিবাদমান পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। উভয়পক্ষের মধ্যে যদি এমন প্রবণতা বা দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি পরিলক্ষিত হয় তাহলে বলা যায় সেই যুদ্ধ এক ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে আগাচ্ছে। এখন দেখা যাক বর্তমানে যুদ্ধে লিপ্ত ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ বা নীতি পরিচালককদের মধ্যে সেই ধরণের কোনো বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে কিনা। এই দিক থেকে উত্তর না হবে। কারণ ভারত বা পাকিস্তান কোনো পক্ষের মধ্যে সেই ধরণের কোনো শক্ত অবস্থান নেই। যে যুদ্ধ খারেজমি সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটি হলো সর্বাত্মক যুদ্ধের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। এই দুই যুদ্ধে ৭০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ ছিল বিবদমানপক্ষ যে কোনো কিছুর বিনিময়ে যুদ্ধে জিততে চেয়েছিল।

সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো ‘পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ’। অর্থাৎ দুই পক্ষ যে কারণে যুদ্ধ করছে তারা কি যুদ্ধের মাধ্যমে সেই বিষয় বা বস্তুর পুরোপুরি বিনাশ চাইছে কিনা। বা দুই পক্ষ এতটা শক্ত অবস্থানে আছে কিনা যে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা অনড় থাকবে। এখন দেখা যাক এই বৈশিষ্ট্যে ভারত ও পাকিস্তান কতটা শক্ত অবস্থানে। দুই দেশের মধ্যে বর্তমান যুদ্ধের অন্যতম কারণ হলো পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। ভারতের অভিযোগ পাকিস্তান এই সন্ত্রাসী হামলার অন্যতম দোসর। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি ভারতে জঙ্গি হামলায় তাদের কোনো দায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভারত কি এই সন্ত্রাসী নির্মূলের যুদ্ধ বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত? ভারতের বর্তমান মনোভাব বা দুই দেশের যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত সেই সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেয়। এই ধরণের সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রথম সারির উদাহরণ হতে পারে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে খারেজমি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত চেঙ্গিস খানের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। যে যুদ্ধ খারেজমি সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে চলমান যুদ্ধকে এই ধরনের সর্বাত্মক যুদ্ধ বলা যায়। কারণ এই যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেইনের কিছু অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষ অবধি চার লাখেরও অধিক সৈন্য নিহত হলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ধর্ম সেই অর্থে প্রভাব না রাখলেও, দেশ দুটিই যুদ্ধকে যৌক্তিক করে তোলার জন্য জনগণের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা জাগাবার চেষ্টা চালায়, যার উদাহরণ ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণ। ছবি: রয়টার্স

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো যুদ্ধ আদর্শিক বা ধর্ম যুদ্ধ। অর্থাৎ কোনো যুদ্ধ যদি আদর্শিক বা ধর্মের জন্য হয় তাহলে সেই যুদ্ধ সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধকে অনেকেটা সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকিতে রাখা যায়। ভারত ও পাকিস্তানের এই যুদ্ধ প্রকৃতার্থে আদর্শিক বা ধর্ম যুদ্ধ না হলেও এটা অস্বীকার করা কঠিন হবে যে দুই দেশের যুদ্ধে ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক আদর্শ কোনো প্রভাব রাখে না। দুই দেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব অনেকটা সেই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু দুই দেশ যে ধর্ম বা আদর্শের জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হবে সেটি শক্ত করে বলা যায় না। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ধর্ম সেই অর্থে প্রভাব না রাখলেও, দেশ দুটিই যুদ্ধকে যৌক্তিক করে তোলার জন্য জনগণের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা জাগাবার চেষ্টা চালায়, যার উদাহরণ ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণ। সিঁদুর হিন্দু সধবা নারীদের কাছে গৌরবের প্রতীক। আদর্শগত সর্বাত্মক যুদ্ধের অন্যতম উদাহরণ হতে পারে ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ বা তৎকালীন ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা শক্তিগুলো’র মধ্যে যুদ্ধ। আর ধর্মভিত্তিক যুদ্ধের ভয়ঙ্কর উদাহরণ হতে পারে মধ্যযুগের ‘ক্রুসেইডস’। মধ্যযুগীয় ওই ধর্মযুদ্ধে আশি থেকে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।

এই সব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বলা যায় বর্তমানে বিবদমান ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আংশিক উপাদান নিহিত থাকলেও শেষপর্যন্ত তা হতে দেবে না বৈশ্বিক শক্তিগুলো। কারণ দুই দেশেই বৈশ্বিক এই শক্তিগুলোর কায়েমী স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সেই আশঙ্কা থেকেই ভারত বা পাকিস্তানকে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে তারা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews