ইসরাইল-ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধে ইরান থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয় যুদ্ধ শেষের ঠিক আগ মুহূর্তে। ইরানের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের মরুভূমি শহর বীরসেবা। সেখানে মঙ্গলবার ভোরের কিছুটা সময় আগে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। বিস্ফোরণে একটি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একপাশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। পরে ভবনের ভেতরে থাকা ‘নিরাপদ’ ঘরের ভেতরেও বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সেখানে থাকা চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এর আগের দিনই ইরান ঘোষণা করেছিল, তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহুমুখী ওয়ারহেডযুক্ত ‘খাইবার শেকান’ নামের ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। এ ক্ষেপণাস্ত্রকে অনেকে ‘দানব ক্ষেপণাস্ত্র’ বলেও থাকেন।

ইসরাইলের সেনাবাহিনী (আইডিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে বীরসেবা হামলায় এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা নিশ্চিত করেনি, তবে দেশের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ একে ‘ইরানের অন্যতম ভারী অস্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হওয়ার পরও ইরান যে এত বড় ধরনের আঘাত হেনেছে, তা স্পষ্ট বার্তা বহন করে। সেটি হলো-ইসরাইল যদি আবারও শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের সাধারণ নাগরিকরাও মরতে থাকবে। আর উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরও ইসরাইল মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে খুব একটা কিছু করতে পারবে না। আর একেই বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা দুর্বল জায়গা।

রোববারে পেতাহ তিকভায় একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৪ জন নিহত হন। ওই সময় দুজন সরকারি অনুমোদিত ‘সুরক্ষিত’ আশ্রয় কক্ষে অবস্থান করছিলেন, তবুও তারা প্রাণে রক্ষা পাননি। যুদ্ধের পক্ষে ইসরাইলে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও এসব ঘটনা সমাজে গভীর আতঙ্ক আর আত্মবিশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে। কারণ, ইসরাইলিরা জানে-ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধ হবে, এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই নতুন বাস্তবতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তেল আবিবের নিচে বিশাল কংক্রিটের জঙ্গলে গড়ে ওঠা তাঁবু শহরগুলোতে। ৫০ বছরের শালহেভেত ফ্রিডম্যান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তেল আবিবের চেয়ে নিরাপদ স্থান ভেবে পেতাহ তিকভায় ছিলাম। কিন্তু হামলার সময় বুঝলাম, আসলে কোথাও নিরাপদ নই। বরং এখানে, নিচে আমরা তুলনামূলক নিরাপদ।’

‘ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স ইন আর্মস’-নামের সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা, সাবেক সাবমেরিন ক্যাপ্টেন ৬১ বছরের রোনেন কোহলার বলেন, ‘বাইরের দুনিয়া ভাবে তেল আবিবে আধুনিক আশ্রয় কক্ষের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ভবন ৪০, ৫০ এমনকি ৬০-এর দশকে নির্মিত। সেগুলো আধুনিক নিরাপত্তা মানদণ্ডের আওতায় পড়ে না।’

তিনি আরও জানান, বয়স্ক নাগরিক ও ছোট শিশুদের নিয়ে যারা থাকেন, তাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ মিনিটের আগাম সতর্কতা যথেষ্ট নয়। এক রাতেই দু-তিনবার বাচ্চাদের জাগিয়ে নিচে নামতে হয়। পুরো রাত নির্বিঘ্নে ঘুমানোর সুযোগটাই বড় ব্যাপার। তিনি বলেন, নিজস্ব আশ্রয় কক্ষ আছে এমন অনেক তরুণও রাত হলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। তারা একা মরার ভয় পায়। আশপাশে মানুষ থাকলে কিছুটা সাহস পায়।

ইসরাইল সরকারকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের লাখো মানুষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৫৬ শতাংশ বাড়িতে কোনো আশ্রয় কক্ষ নেই। আর ১২ হাজার সরকারি আশ্রয় কক্ষ বেহাল অবস্থায় আছে। বেশির ভাগ ইসরাইলি হয়তো এ প্রতিবেদনের কথা জানে না, তবে এর বাস্তবতা তারা ভালোভাবেই বুঝে গেছে।

এর আগে, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইল আইন করে, নতুন সব বাসাবাড়িতে সুরক্ষিত কক্ষ রাখতে হবে। বর্তমানে দেশের বাড়িগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ের ৩ ধরনের হয়ে থাকে-মামাদ বা ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে থাকা সুরক্ষিত ঘর, মামাক বা প্রতিটি ফ্লোরে কমিউনাল নিরাপদ ঘর এবং মিকলাট বা সরকারি আশ্রয় কক্ষ। তবে এসব ব্যক্তিগত আশ্রয় সুবিধাও মূলত ধনী শ্রেণির নাগালে-এমনটাই বলা হয়েছে সেই সরকারি প্রতিবেদনে। তবে বাস্তবে দেখা গেছে তেল আবিবের কম আয়ের দক্ষিণাঞ্চলের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের কাছে গুমোট, অন্ধকার, দুর্গন্ধযুক্ত কংক্রিটের গহ্বরে গড়ে ওঠা আরেকটি তাঁবু শহরে।

সেখানে ১১ মাসের শিশুকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন ফিলিপাইনের গৃহকর্মী লিন তাগাকাই। তিনি বলেন, ‘আমাদের আশপাশে কোনো বোমা আশ্রয় কক্ষ ছিল না। আমি দৌড়ে সেখানে যেতে পারতাম না। খুব ভয় লাগত। তাই নিচে চলে আসাটাই সহজ মনে হয়েছে।’ এখন যখন ক্ষেপণাস্ত্রের ধুলো ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে, তখন ইসরাইলে শুরু হয়েছে নতুন প্রশ্ন-কিভাবে সাধারণ মানুষকে আরও ভালোভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়?

যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিজয় ঘোষণা করেছেন, এখনো পরিষ্কার নয় ইরান পারমাণবিক অস্ত্রে কতটা সক্ষম। ফলে ইসরাইল নতুন করে হামলা চালালে ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিশ্চিত নয়। তবে এটা জানা গেছে, ইরানের কাছে এখনো শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত আছে। আর ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নতই হোক, তা শতভাগ কার্যকর নয়।

এ কারণে তেল আবিবের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা কয়েকশ মানুষ আর পুরো দেশের প্রায় ১০ হাজার উদ্বাস্তু জানে-এই পরিস্থিতি আবারও ফিরে আসতে পারে, খুব বেশি সময় নাও লাগতে পারে এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা মোটেও নিরাপদ নন।

সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করতে ব্যর্থ ইসরাইল : এদিকে ইরানে ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল সামরিক পরিকল্পনায় দক্ষতার প্রমাণ দিলেও, দেশের ভেতরে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হারেৎজ পত্রিকা। একেই ইরান যুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ দিনের অভূতপূর্ব সামরিক সাফল্যের মধ্যেও ইসরাইলের অভ্যন্তরে এক ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এসেছে। তা হলো অসংখ্য সাধারণ নাগরিক রয়ে গেছে সম্পূর্ণ সুরক্ষাহীন, পরিত্যক্ত, অরক্ষিত অবস্থায়। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং গোয়েন্দা সাফল্য যেখানে আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছে, সেখানে রাজধানী তেল আবিব থেকে শুরু করে হাইফা ও বাত ইয়ামের মতো শহরগুলোতে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

তেল আবিবের এক অভিজাত এলাকায় বাসিন্দা এক নারী জানান, তার নিজস্ব আবাসিক শেল্টার অকার্যকর। কাঠের দরজার সেই ঘরটি ছিল ব্যবহার অনুপযোগী। প্রতিবার সাইরেন বাজলে তাকে বাড়ি থেকে দুই মিনিট দূরের প্রতিবেশীর বাড়িতে ছোট একটি টানেলের মতো শেল্টারে যেতে হতো, যা একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় ছিল। অনেকেই পার্কিং গ্যারেজে রাত কাটিয়েছেন, যাতে হঠাৎ হামলার সময় নিরাপদে থাকতে পারেন।

ইসরাইলি বাহিনী দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে। তবে নিজ দেশের জনগণের জন্য আশ্রয়স্থলগুলোর সংস্কার বা প্রস্তুতির কোনো উদ্যোগ ছিল না। যুদ্ধ শুরুর ৭ দিন পর সরকার মাত্র ১০০ মিলিয়ন শেকেল (প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ দেয় বিদ্যমান শেল্টার মেরামত ও চলমান শেল্টার স্থাপনের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট নতুন নয়। ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধের মধ্যেও কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বহু শেল্টার ছিল পরিত্যক্ত ও অকার্যকর। এমনকি অবৈধভাবে বসবাসরত বেদুইন গ্রামগুলোতে কোনো ধরনের মোবাইল শেল্টার ছিল না।

ইরানের দিক থেকে ছোড়া প্রায় ৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ১০০০ ড্রোনে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৯ জন। হাইফা, বীরসেবা, রামাত গ্যান, রিশন লেৎসিয়ন ও তামরার মতো শহরগুলোতেও ব্যাপক হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। সেনাবাহিনী বলছে, তারা অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রস্তুত ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়তো প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রায় ১০ হাজার ইসরাইলি শরণার্থী হয়ে পড়েছে। আর অগণিত মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলের যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কার্যত কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। আগামী যে কোনো যুদ্ধের আগে যদি এই শিক্ষা থেকে সরকার না শেখে, তবে আরও অনেক জীবন বিপন্ন হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews