আজ তাঁরা বলে দেবেন সব। লুকিয়ে রাখার সময় আর নেই। দুই মহিলা বন্ধু তাঁদের পরিবারকে জানিয়ে দেবেন বন্ধুতার বাইরে আজ তাঁরা ‘কাপল’। আর এই প্রথম সাক্ষাতে পার্টনারের মা-কে খুশি করার জন্য তাঁদেরই একজন বলে উঠলেন, ‘‘আমি চাই তোমার মা আমাকে পছন্দ করুন। সে জন্যই তোমার কমলা রঙের কুর্তাটা আমি পরেছি।’’ অপর জন মুচকি হেসে বললেন, ‘‘আমার মা কিন্তু মেয়েদের ছোট চুল পছন্দ করে না।’’ ছোট চুলের মেয়েটির চোখে বিস্ময়। তার পার্টনারকে খুশি করার জন্যই তো তার এই ছোট করে চুল কাটা। তা হলে? শুনে প্রথম মেয়ে কাছে টেনে নেয় বান্ধবীকে। বলে, ‘‘আমি তোমায় ছোট চুলেই দেখতে চাই।’’ আলতো হেসে দুজনে আরও কাছে আসে।
তিন মিনিটের এই বিজ্ঞাপন তুলে ধরেছে সমকামী যৌনতার এই অনায়াস ছবি। ফেসবুকে ইতিমধ্যেই এই বিজ্ঞাপনী ভিডিয়োয় লাইক প্রায় ১৫ হাজার। পাশাপাশি চলছে অগুন্তি শেয়ার আর কমেন্ট। তবে বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায় যুগান্তকারী বদল কিন্তু শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই। ২০১৩-য় এক গয়নার বিজ্ঞাপনে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ডিভোর্সি মহিলার বিয়ে তুমুল আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। বদলাচ্ছে সময়। যে সামাজিক বিষয়কে আমরা ঘৃণা, অবিশ্বাসের চোখে দেখতাম, সেগুলোই যেন সহজ ভাবে ধরা দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সদ্যই ক্রীড়াবিদ ব্রুস জেনার যেমন লিঙ্গ পরিবর্তন করে হয়েছেন ক্যাটলিন জেনার। আবার অন্য দিকে এক বেপরোয়া মা তাঁর ছেলের বিয়ের জন্য সামাজিক চাপকে উপেক্ষা করে পাত্রের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। সেই সূত্রেই চলে এল এই লেসবিয়ান কাপলের অ্যাড।
এই বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে কলকাতার মেয়ে স্টাইলিস্ট নেহা পণ্ডা ইতিমধ্যেই ‘টক অব দ্য টাউন’। তাঁকে ফোনে পাওয়াই যাচ্ছে না। বন্ধুদের কমেন্টে ভরে গিয়েছে তাঁর ফেসবুক ওয়াল। এক বলিউডি ছবিতে রূপান্তরকামীর চরিত্রে অভিনয়ের অফারও পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘আমার ছোট করে কাটা চুল আর চেহারার জন্য অনেক বারই গে চরিত্রে অভিনয়ের অফার পেয়েছি আমি। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনটা নিজে থেকেই করতে চাইছিলাম। অডিশনে পাসও করে যাই।’’ কথায় কথায় আরও বলেন, ‘‘আমার অনেক লেসবিয়ান আর গে বন্ধু আছে। আমি সমকামীদের অধিকারের পক্ষে। কিন্তু যখন দেখলাম একজন লেসবিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে, তখন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কৌন হোগি লড়কি? ক্যয়সি হোগি?’’ ভাবতেই পারেননি ‘ববি জাসুস’য়ে অভিনয় করা অনুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রিটা এমন দুর্দান্ত ক্লিক করে যাবে। একটা চুম্বনদৃশ্য ছিল ওই বিজ্ঞাপনে। কিন্তু নেহা আর অনুপ্রিয়া যে ভাবে ভালবাসার অভিব্যক্তিটা তাঁদের শরীরী বিভঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে আর দৃশ্যটা আলাদা ভাবে শ্যুট করতে হয়নি। নেহার পরিবার তাঁর এই উদ্যোগে যথেষ্ট গর্বিত। এমনকী বিজ্ঞাপনটা দেখার পর বন্ধুরা মজা করে বলছেন নেহা বোধহয় সত্যিই লেসবিয়ান হয়ে গেল। নেহা কিন্তু বিষয়টা বেশ উপভোগ করছেন। আর বয়ফ্রেন্ড? ‘‘ওর তো খুব সন্দেহ ছিল আমি লেসবিয়ান প্রেমটা পর্দায় ফোটাতে পারব কি না। বিজ্ঞাপনটা দেখার পর যদিও ওই প্রথম প্রশংসা করেছে আমাকে।’’
লেসবিয়ান সম্পর্কের প্রেক্ষিতেই কি এত জনপ্রিয় হল এই বিজ্ঞাপন? একসময় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরিচালক সুজিত সরকার। বললেন, ‘‘সম্পর্ককে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করা হলে দর্শক দেখতে পছন্দ করেন। আর যে বিজ্ঞাপনে বদলে যাওয়া সম্পর্ককে একটা সম্ভ্রান্ত মোড়কে দেখানো হচ্ছে, সেটা তো লোকে বারবার দেখতে চাইবে। আজকের মেয়েদের স্বাধীনতার বিষয়টা বদলে গিয়েছে। এই স্বাধীনতা যৌন স্বাধীনতাকেও একটা মাত্রা দিয়েছে। আমরাও সেটা দেখতে খুব কমফর্টেবল।’’
বিজ্ঞাপনে দুই নারীর প্রেমের গল্পকে সহজ ভাবে দেখানোতে খুশি লেখিকা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘এই ধরনের সামাজিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে আজ যে রাখঢাক নেই, সেটা সত্যিই প্রশংসার বিষয়। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। আজ যদি আমার ছেলে একজন বয়ফ্রেন্ড এনে হাজির করে তা হলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। আসলে এই সমকামী সম্পর্কে দুজন নারীর একজন পুরুষের ভূমিকায়। আরেকজন মহিলা। এটাও ভাববার।’’ অফিস থেকে বাড়ি— সর্বত্রই এই লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে খুল্লমখুল্লা আলোচনা চলছে। প্রকৃতিগত ভাবে অন্য রকম এই সম্পর্কগুলোর প্রতি মানুষ এখন অনেকটাই সহনশীল। সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট রত্নাবলী রায় বললেন ফেসবুক থেকে ট্যুইটারে এই বিজ্ঞাপনকে ঘিরে বিপুল আলোড়ন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের সম্পর্ককে কি সত্যিই সহজ ভাবে দেখা হবে? প্রশ্ন তুলেছেন লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদারও। এই বিজ্ঞাপনকে নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক হিসেবে ব্যাখ্যা করে তিলোত্তমা বললেন, ‘‘ইদানীং সমকামী কাপল অনেক বেড়ে গেছে। আমার মনে হয় এখন অনেকে সেক্সুয়াল স্টার্ভেশন থেকে সমকামীতায় ঝুঁকছে। নিজের স্বাভাবিকত্বকে বিলুপ করে কোনও একটা উদ্দেশ্যে এই কৃত্রিম ভাবে সেক্স চে়ঞ্জটা কিন্তু ক্ষতিকারক। সেটাও কি আমরা ভাবব না?’’
এত কিছুর পরেও আইনের চোখে সমকামীতা এখনও স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। তা হলে কি যেটা চলছে সেটা কি নিতান্তই গিমিক? ‘‘একেবারেই না,’’ বললেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। অনেক দিন আগেই লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ছবি ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ বিতর্ক তুলেছিল। কৌশিক বললেন, ‘‘মানুষ আইনের উর্ধ্বে। এই সম্পর্কগুলোকে সহজ ভাবে নিলেই ভাল। যিনি এই অ্যাডটি তৈরি করেছেন, তাঁকে সাধুবাদ। সমাজের পালসটা তিনি ধরতে পেরেছেন। সমাজ বদলাচ্ছে। এ বার আইনও বদলাবে।’’