২০২৪ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার)। চলছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন। এ দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জ্বলতে থাকে ক্ষোভের আগুন। সেই সাথে বাড়তে থেকে লাশের সারি। ঢাকার প্রায় প্রতিটি সড়কে আগুন জ্বেলে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, গণতন্ত্র মঞ্চ, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। আর সেখানে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে পুলিশ আনসার, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা। কোথাও কোথাও উপর থেকে হেলিকপ্টারে করে গুলি চালানো হয়। পুলিশ-র্যাব-আনসার সদস্যদের এলোপাতাড়ি গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ডগ্রেনেডের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজধানীসহ গোটা দেশের মানুষ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, ওই দিন গুলিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৬৭ জন নিহত হন। শুধু ঢাকায় ৬২ জন নিহত হন। ঢাকার বাইরে রংপুরে দু’জন, সাভার, সিলেট ও নরসিংদীতে একজন করে মোট পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
সেদিন সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে অচল হয়ে গোটা রাজধানী- মালিবাগ, রামপুর, বাড্ডা, বারিধারা, প্রগতি সরণি, কাকরাইল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, প্রেস ক্লাব। অপর দিকে কাঁচপুর থেকে শুরু করে কাজলা, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মতিঝিল, ফকিরাপুল। আবার শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়ার প্রধান সড়কগুলো আটকে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। তারা রাস্তায় টায়ার, কাঠ জ্বালিয়ে বিভিন্ন ধরনের সে্লাগান দিতে থাকে।
শুক্রবার সকাল থেকে রামপুরা, বাড্ডা এবং যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় শুরু হয় প্রথম আন্দোলন। বৃহস্পতিবার রাতের আন্দোলন পুরোপুরি শেষ না হলেও কিছুটা নমনীয় ছিল। কিন্তু পরের দিন সকাল হতেই রাস্তায় নামেন আন্দোলনকারীরা। তখনই গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে পুলিশ। শুরু হয় দিনের প্রথম সংঘর্ষ। অপরদিকে মালিবাগ, রামপুরা থেকে বাড্ডা পর্যন্ত জ্বলতে শুরু করে প্রগতি সরণি সড়ক। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও র্যাব সদস্যরা গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলিতে বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে ওই লাশগুলোর পরিচয়ও পাওয়া যেতেন না। সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রামপুরায় তাণ্ডব চালায়। তাদের ব্রাশ ফায়ারে কমপক্ষে ৩০০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের অনেককে স্থানীয় ফরাজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিন ওই হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজার রুবেল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, এত রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আমাদের নেই। তারপরও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রত্যেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। রামপুরা ডেল্টা হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অজ্ঞাত একজনের লাশ রয়েছে। গুলিবিদ্ধ রয়েছেন আরো কয়েকজন।
১৯ জুলাই শিক্ষার্থী ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিনভর ব্যাপক সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়। হাসপাতালগুলোতে গুলিবিদ্ধ মানুষের ঢল নামে। আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। এদিন বিআরটিএ ভবন ও পিবিআই কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকায় মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ডিএমপি।
রাতে গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, বিজিবির ডিজি ও ডিএমপি কমিশনার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়। মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। কিন্তু পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল থেকেই দ্বিতীয় দিনের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালনে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা ও মহাখালীতেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘিরেও রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে প্রেস ক্লাব ও পল্টন এলাকাজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষের চিত্র দেখা যায়।
ঢাকার বাইরে খুলনার শিববাড়ী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, রংপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গোলযোগের মধ্যে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের জিম্মি করে সেখান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়া হয়। শুক্রবার দিনভর সংঘর্ষে শুধু হতাহত নয়, অনেক সরকারি-বেসরকারি ভবন ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। রামপুরা থানা ও রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পূরবী পর্যন্ত পাঁচটি পুলিশ বক্সে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। বনানীতে বিআরটিএর সদর কার্যালয়, মিরপুরে অবস্থিত সংস্থাটির মেট্রো-১ কার্যালয়, মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পুরনো ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মিরপুরে বিআরটিএ অফিসে থাকা বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
১৯ জুলাই মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাস চলাচল। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক অনেক ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ঢাকার সাথে সারা দেশের রেল চলাচলও বন্ধ ছিল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানান।
এদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘তারা আকাশ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি ছোড়া হয়নি, বরং উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। বিজিবির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে যারা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা হবে।’এদিন সরকারের সাথে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন ৯ দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান তাদের অভিভাবকরাও। ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ শীর্ষক ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করেন সর্বস্তরের অভিভাবক সমাজ।