নিউজ আপলোড : ঢাকা , শনিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২০

শিক্ষা প্রশাসন জাতীয়করণ হওয়া ৩০২টি কলেজ নিয়ে নানামুখী সংকটে পরেছে। একদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি আত্মীকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছে, আরেকদিকে কলেজগুলোতে একডজন নতুন সমস্যা শনাক্ত হয়েছে। এসব নিরসনে হিমশিম খাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আত্মীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পাঁচটি কমিটি গঠন করলেও তাদের কার্যক্রমে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের। যদিও ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে অনেক শিক্ষকের সনদ ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা রকম ত্রুটিও পাচ্ছেন কর্মকর্তারা।

বর্তমানে শতাধিক কলেজে অধ্যক্ষ নেই। ওইসব কলেজে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙে পরার উপক্রম হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল কবির চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ায় জাতীয়করণের ঘোষণার পর বিভিন্ন সময়ে ওইসব কলেজের অধ্যক্ষ অবসরে গেছেন। কিন্তু নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয়েছে। সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে ওই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।’

ওইসব কলেজে ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্য’দের পদায়ন বন্ধ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্ধ হয়নি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে নয়, তালিকা করে একসঙ্গে অনেকগুলো কলেজে অধ্যক্ষ পদায়ন দেয়া হবে। এ কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।’

জাতীয়করণ ঘোষিত কলেজগুলোতে মাউশি সম্প্রতি এক ডজনের বেশি সমস্যা চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো-ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বভার প্রদান, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায়, শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিল, গ্র্যাচুয়েটি প্রদান, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নাম, জন্মতারিখ, বিষয়, ইনডেক্স ও পদবি সংশোধন, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ, অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী শিক্ষক, ভুয়া নিবন্ধন সনদে চাকরি পাওয়া শিক্ষক ইত্যাদি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘জাতীয়করণের ঘোষণার আগ মুহূর্তে পুরোনো তারিখ দেখিয়ে কলেজগুলোতে বিশেষ করে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের জন্য ইচ্ছেমতো শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়োগের ন্যূনতম শর্ত পূরণ করা হয়নি। তাদের সনদ ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে, এর ফলে কার্যক্রমে বিলম্ব হচ্ছে। ওইসব শিক্ষকের একটি বড় অংশই এখন চাকরি থেকে বাদ পড়ছেন। আবার জাতীয়করণের ঘোষণার পর টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষকদের মধ্যে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।’

মাউশি কর্তৃপক্ষ সরকারিকরণ হওয়া ৩০২টি কলেজের ওইসব সদস্যা নিরসনের লক্ষ্যে গত ১৮ অক্টোবর এক দফা বৈঠক করেছে। মাউশি কর্মকর্তারা কলেজগুলোর বিদ্যমান সমস্যা ও সংকট নিরসনের লক্ষে খুব শীঘ্রই আরেক দফা বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। এ বিষয় সমন্বয় করছেন মাউশি’র উপ-পরিচালক (কলেজ-২) এনামুল হক হাওলাদার।

তিনি সংবাদকে বলেন, ‘অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানে সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানেও সমস্যা হচ্ছে। যারা এমপিওভুক্ত ছিলেন তারা এমপিও পাচ্ছেন, কিন্তু যারা নন-এমপিও ছিলেন তাদের বেতন দেয়া হতো কলেজের তহবিল থেকে.....কলেজে আয়-উপার্জন না থাকলে তাদের বেতন দেবে কিভাবে?’

অধ্যক্ষ না থাকায় বেশ কয়েকটি কলেজে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা চলছে জানিয়ে মাউশি’র অপর এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমদিকে অর্ধশতাধিক কলেজের অধ্যক্ষ পদে ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার’র শিক্ষকদের প্রদায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা এখন ওইসব কলেজে পদায়নে যেতে নারাজ। এ কারণে পরবর্তীতে কলেজের নিজস্ব শিক্ষকদের মধ্য থেকেই সিনিয়র শিক্ষকদের কাউকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।’

জাতীয়করণ হওয়া কলেজের মধ্যে অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কিভাবে দেয়া হচ্ছে বা আদৌ পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে এনামুল হক হাওলাদার বলেন, ‘এগুলো নিয়েও সমস্যা হচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী, সরকারি হাইস্কুল ও কলেজ নেই-এমন সব উপজেলায় একটি হাইস্কুল ও একটি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়। ২০১৬ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০১৮ সালে মোট ৩০২টি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়। এরমধ্যে ২০১৮ সালের আগস্টের মধ্যে ২৭১টি এবং পরবর্তীতে কাছাকাছি সময়ে আরও ৩১টি কলেজকে সরকারি করা হয়। সব মিলিয়ে মোট ৩০২টি বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) কলেজ সরকারি বা জাতীয়করণ করা হয়। কলেজ সরকারি হলেও শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি আত্মীকরণ নিয়ে সংকটে পড়ে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ৩০২টি প্রতিষ্ঠানের জনবল আত্মীকরণের প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাউশি’র প্রতিবেদনের আলোকেই এখন জনবল আত্মীকরণের কাজ করছেন। তাদের যাচাই-বাছাই শেষে জনবলের তালিকা যাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, এই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে তা যাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আরও কিছু প্রক্রিয়া থাকে, সেগুলো সম্পন্ন হলেই শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি স্কেলের পুরো সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ‘সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি’র (সকশিস) সভাপতি জহুরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘সবকটি কলেজের ওপরই মাউশি কর্মকর্তারা প্রতিবেদন করেছেন, শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা তৈরি করেছেন। এখন আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করছে। তারা যাচাই-বাছাই শেষে কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এভাবে কত বছরে সবার চাকরি আত্মীকৃত হবে? যাচাই-বাছাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলো চরম গাফিলতি করছেন। তারা এক সপ্তাহে মাত্র ২/৩টি কলেজের কাজ শেষ করছেন।’

বারবার যাচাই-বাছাইয়ের নামে ৬০ ভাগ শিক্ষক-কর্মচারী তালিকা থেকে বাদ পরছেন দাবি করে জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থাৎ যারা বাদ পরছেন তাদের চাকরি নেই। আমাদের কাছে তথ্য আছে, ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজের (জাতীয়করণ হওয়া) ৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১৮ জনই বাদ পরেছে, ত্রিশাল কলেজের ৫২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ২০ জনই বাদ পরেছে। বাদ পড়াদের বেশির ভাগই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তারা এখন কি করে খাবেন?’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আসলে জাতীয়করণের কোন সুবিধা এখনও শিক্ষক-কর্মচারীরা পাইনি। কলেজগুলোর কেবল সাইনবোর্ড পরিবর্তন হয়েছে। নামের সঙ্গে ‘সরকারি’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে।’

জানা গেছে, সরকারি হওয়া ৩০২টি কলেজের মোট এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন ১২ হাজার ৫৫৬ জন। আর নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন চার হাজার ৫৬৫ জন। তবে শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউই এখনও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাননি। অর্থাৎ কারোর চাকরিই আত্মীকরণ হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারিকরণের ঘোষণার পর থেকেই কলেজগুলোতে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-উপার্জনও কার্যত নেই। কারণ সরকারিকরণের সুবিধা না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা আগের মতো উচ্চহারে টিউশন ফি পরিশোধ করছে না। এতে ওইসব কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা (এমপিও) পেলেও নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতন জীবনযাপন করছেন। তারা বেতনভাতা পাচ্ছেন না বললেই চলে। আবার যেসব কলেজে নিয়মিত অধ্যক্ষ নেই সেগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে গ্রুপিং ও দলাদলি তুঙ্গে। বেতন-ভাতা না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদেরও কলেজে যাতায়াত অনিয়মিত হয়ে পরছে। আর্থিক উৎস না থাকায় ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার’র সদস্যরা ওইসব কলেজের অধ্যক্ষের পেদে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন।

এ ব্যাপারে মাউশি’র পরিচালক প্রফেসর শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘মাউশি কেবল জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোর ওপর পর্যবেক্ষণ আকারে প্রতিবেদন প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বা চাকরি থেকে কাউকে বাদ দেয়ার এখতিয়ার মাউশির নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার পুরো এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের। যুক্তিসঙ্গত কারণ বা সনদে ত্রুটি বা অন্য কোন কারণে কেউ যদি বাদ পড়েন সেটিও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে।’

তিনি জানান, ‘৩০২টি কলেজের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গত জানুয়ারির মধ্যে মাউশি কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। এখন মূলত মন্ত্রণালয়ের কাজ। মাঝেমধ্যে দু’একটি বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে আমরা তা পাঠাচ্ছি।’

জাতীয়করণ হওয়া কলেজের শিক্ষকরা নিজস্ব তহবিল (এফডিআর) থেকে বেতনভাতা পরিশোধের দাবি করে আসছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রফেসর শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে কলেজগুলোর চুক্তি অর্থাৎ ডিড অব গিফ্ট অনুযায়ী কলেজগুলোর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এখন সরকারের। তাদের ব্যাংক হিসাবগুলোও সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ওইসব ব্যাংক হিসাবে যে পরিমাণ অর্থ রয়েছে, তা দিয়ে কোন কোন কলেজের শিক্ষকদের দু’একমাসের বেতন-ভাতা দেয়া হয়তো সম্ভব হবে। কিন্তু এরপর কি হবে? আবার সব কলেজের আর্থিক অবস্থা ভালোও নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সরকার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আত্মীকরণের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews