সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে গভীর পটপরিবর্তন হয়েছে। ফলে প্রতিবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের প্রেক্ষাপট অবশ্যই ভিন্ন। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিশাল। এই প্রত্যাশা সম্পূর্ণভাবে পূরণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে যতটুকু প্রত্যাশা পূরণ করা যায়, সে চেষ্টা থাকতে হবে। পাশাপাশি সরকার দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করছে, এই মর্মে একটি সিগন্যাল (দিকনির্দেশনা বা দৃষ্টিভঙ্গি) দেওয়া জরুরি। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন। তার মতে, এবারের বাজেটের আকার বাড়ানোর মোহ থেকে মুক্ত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে বাজেটে তিনটি দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে বিদ্যমান বাস্তবতার গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ থাকতে হবে; দ্বিতীয়ত, গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাব থেকে বের হয়ে এসে ‘লো হ্যাংগিং ফ্রুটস’ বা সহজে বাস্তবায়নযোগ্য বাস্তবমুখী কর্মসূচিতে জোর দেওয়া; তৃতীয়ত, যৌক্তিক বরাদ্দ ও ব্যয়ের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এছাড়া দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্ব আয় এবং আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি মনির হোসেন

যুগান্তর : বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর : ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি যেভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেখানে বর্তমানে অনেকটা স্থিতিশীল হয়েছে। তবে দুটি সূচক এখনো উদ্বেগজনক। এর মধ্যে একটি হলো-মূল্যস্ফীতি অপরটি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। এখানে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। আর অগ্রগতি না হওয়ার অন্যতম কারণ, দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে গোষ্ঠীতন্ত্রের কবলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে এখনো সম্পূর্ণ উত্তরণ হয়নি। অর্থাৎ আগের সরকার বিদায় নিয়েছে, আর গোষ্ঠীতন্ত্র চলে গেছে বিষয়টি এমন নয়। ২০১৩ সাল থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী শাসন ছিল, তার অন্যতম একটি দিক হলো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টকে (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) মেইন স্ট্রিম করে ফেলা। অর্থাৎ স্বার্থের দ্বন্দ্বকে নিয়ন্ত্রণতো দূরের কথা, সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-বিভিন্নভাবে ব্যাংক, বিমা কিংবা মিডিয়ার মালিকানা দখল করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সরকারের ভেতরে এখনো তাদের ক্যাপাসিটি আছে। ফলে নতুন শক্তি নিয়ে তাদের ফিরে আশার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি এবং বিনিয়োগ এই দুই সূচক স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো বিবেচনা করলে দেখা যাবে ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আমরা খেলাপি হইনি। এছাড়াও বর্তমানে বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়ছে। মুদ্রার বিনিময় হার যৌক্তিক করা হচ্ছে।

যুগান্তর : নতুন বাস্তবতায় এবারের বাজেট পেশ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাজেটে কী কী চ্যালেঞ্জ থাকছে?

ড. হোসেন জিল্লুর : এবারের বাজেটের প্রেক্ষাপট অবশ্যই ভিন্ন। কারণ গভীর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর আগের বাজেটগুলো গোষ্ঠীতন্ত্র প্রভাবিত দুর্নীতিগ্রস্ত নীতির মধ্য দিয়ে হচ্ছিল। কিন্তু এবার মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা আছে। তবে সমাজের বা অর্থনীতির প্রয়োজনে প্রতিবছরই আগের বাজেটগুলোর কিছু ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়। যেমন দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষকের সমস্যা মেটানো এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির গতি স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে নিয়ে আসা অন্যতম। তবে আমার বিবেচনায় এবারের বাজেটে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে রয়েছে-দেশে সম্পদের স্বল্পতা রয়েছে। রাজস্ব আহরণ কম এবং নানাভাবে বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে। এটি একটি বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, বিশাল পটপরিবর্তন হয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি চাপ আছে। আবার এই দুই বাস্তবতার মধ্যে আমলাতান্ত্রিক গতানুগতিকতা পরিহার করে উদ্ভাবনী নেতৃত্ব (লিডারশিপ) দেখানোর সুযোগ আছে। তবে সুযোগের মানে এই নয় যে, হঠাৎ করে বিশাল কোনো প্রকল্প নিতে হবে। চ্যালেঞ্জের তৃতীয় বিষয় হলো-অর্থ বরাদ্দের আকার। এই আকার অবশ্যই বাস্তবসম্মত হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে ব্যয়ের দক্ষতা।

যুগান্তর : গত এক দশকের বাজেটের সঙ্গে এবারে কী পার্থক্য আশা করছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর : ওই সময়ে বাজেটের আকার বাড়ানোটাই সফলতার একটা সূচক মনে করা হতো। কিন্তু বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে বিভিন্ন খাতের বরাদ্দের আকার কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে ইতিবাচক খবর হলো-এবার বাজেটের আকার বাড়ানোর মোহ থেকে মুক্ত থাকার একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এর বাইরেও স্বৈরাচারী শাসনামলে তিনটি অগ্রহণযোগ্য প্রবণতা দিয়ে সেই সময়ের বাজেটকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। একটি হলো, বাস্তবতা বিবর্জিত অর্থনীতির বিশ্লেষণ। এমনভাবে বিশ্লেষণ করা হতো, যেন অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ভালো আছে। দ্বিতীয়ত, গোষ্ঠীতন্ত্রকে তোয়াজ করার জন্যই নীতিজগতকে জানানো হতো। অর্থাৎ এমন পদক্ষেপ নেওয়া হতো যাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উৎসাহিত হয়। তৃতীয়টি হলো, ব্যয় অদক্ষতা। অনেকে মেগা প্রকল্পের সমস্যার কথা বলেন। কিন্তু আমার মতে, মেগা প্রকল্প বড় সমস্যা নয়। সমস্যা হলো ব্যয়ের দক্ষতা ছিল না। যেমন বালিশের দাম এবং রাস্তা নির্মাণ খরচসহ বেশকিছু অস্বাভাবিক ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ হয়েছে। এই তিন খাতেই এবারের বাজেটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যুগান্তর : বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কৌশলগত দিক থেকে আপনার সুপারিশ কী?

ড. হোসেন জিল্লুর : বাজেটের তিনটা দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো-অর্থনৈতিক বাস্তবতার গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো-বিভিন্ন খাতে সিগন্যাল জরুরি। বেসরকারি খাত, সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহারের বিষয়ে কী সিগন্যাল দেওয়া হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অগ্রাধিকার খাত বা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী? তা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। অর্থাৎ সব খাতে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব না হলেও পলিসি সাপোর্ট (নীতি সহায়তা) দেওয়া জরুরি। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ইতোমধ্যে দুভাগ করা হয়েছে। এটি বড় ধরনের সিগন্যাল। এর মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে, রাজস্ব আহরণকে সরকার আরও বাস্তবমুখী করতে চায়। সর্বশেষ বিষয় হলো বরাদ্দ। আবার বরাদ্দের দুটি অংশ আছে। প্রথমত বরাদ্দ দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ানো। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর বাইরেও কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন কর্মসংস্থান বাড়াতে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। তবে কর্মসংস্থানের মানে এই নয় যে সরকার নিজেই কর্মসংস্থান বাড়াবে। বেসরকারি খাতের বিকাশে সরকারকে নীতি সহায়তা দিতে হবে। কৌশলের ক্ষেত্রে আমার কিছু প্রত্যাশা আছে। যেমন লো হ্যাংগিং ফ্রুটস (সহজে অর্জনযোগ্য লক্ষ্য) বাস্তবায়নে জোর দেওয়া। এটি বাস্তবায়নে গভীর কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন নেই। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। এখানে বাজেটের আকারের বিষয় আছে। এরপরও সেখানে নজর দিতেই হবে। শিক্ষা খাতে প্রাইমারি স্টাইফেন নামে একটি কর্মসূচি আছে। ২০০৪ সালে এটি শুরু হয়। ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীকে মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো। এখানে স্বচ্ছতা আছে। লিকেজের আশঙ্কা কম। ফলে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। আরেকটি বড় ইস্যু আছে। যেমন বলা হয়-স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ১৫ শতাংশ ব্যয় হবে। এটি অবাস্তব। কিন্তু এখানেও সহজে অর্জনযোগ্য কর্মসূচিতে ব্যয় বাড়ানো উচিত। যেমন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন প্রকল্পে ৪০ শতাংশ পদ এখনো খালি আছে। জনবলের এই ঘাটতির কারণে মানুষ সেবা পান না। ফলে এখানে বিশেষ বরাদ্দ দিলে একটি উদাহরণ হয়ে থাকত। চূড়ান্ত কথা হলো সম্পদের নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও আকাঙ্ক্ষা বিশাল। এটি মাথায় রাখতে হবে।

যুগান্তর : সুনির্দিষ্টভাবে কোন খাতে অগ্রাধিকার প্রত্যাশা করছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর : বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াতে গত তিন-চার দশক ধরে দুটি চালকই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। একটি হলো তৈরি পোশাক এবং অন্যটি রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। এই দুটি থাকবে। এর সঙ্গে প্রবৃদ্ধির নতুন চালক তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি, ওষুধ খাত, আইটি সেবা এবং চামড়া শিল্প অন্যতম। বাজেটে এসব খাত নিয়ে একটি বার্তা আসা উচিত। খাতগুলোকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দিতে হবে।

যুগান্তর : সরকারের রাজস্ব আয়ের খাতগুলো দুর্বল হয়েছে। আয় বাড়ানোর উপায় কী?

ড. হোসেন জিল্লুর : অবশ্যই আয়ের খাতগুলো দুর্বল হয়েছে। এটি একটি বাস্তবতা। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি। সেক্ষেত্রে ঋণ নেওয়া একটি কৌশলগত দিক। কিন্তু শুধু ঋণ নিলে হবে না। অপচয় কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। এছাড়াও আয় বাড়াতে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। বেসরকারি খাতে নীতি সহায়তা দিয়ে ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। তবে যাদের জন্য সংস্কার, অবশ্যই তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews