গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। তবে এ একে দুঃসময়ের বাজেট বলে মনে হচ্ছে না। বরং এ বাজেট বিশ্লেষণ করে অনেকটাই মনে হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ বাড়িয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়।





ঢাকের বাজনাটা অনেকটা তা-ই। মোট বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার, যেটা স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বাজেট। বাজেটের আকার বড় হয়েছে ঠিক আছে; কিন্তু এ বাজেটের পরিচালনাগত ব্যয়ের বিষয়টি লক্ষণীয়।

বাজেটের পরিচালনাগত ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। অথচ এর গুরুত্ব বিশাল। বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার পরিচালনার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, আর উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। ৩-৪ বছর ধরে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় পরিচালনাগত বাজেটের আকার অনেকটা বেশি গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এর অর্থ হচ্ছে, উন্নয়ন বাজেট পুরো ব্যয়ের দিক দিয়ে বাড়ছে; কিন্তু পরিচালনাগত বাজেট, যেটাকে সরকারের রেভিনিউ বাজেট বলা হয়, সেটার বৃদ্ধি আরও অনেকগুণ। এর অর্থ হচ্ছে, সরকার দেশের জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করছে; কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে রেভিনিউ বাজেটে।

এখন প্রশ্ন হলো, রেভিনিউ বাজেটে কী আছে? এর উত্তর হলো, সরকারি আমলা থেকে শুরু করে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৪-১৫ লাখের মতো। এ বিশাল আকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতার বিরাট খাতটি রেভিনিউ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি হচ্ছে, সরকারের ঋণের সুদ। সরকার অতীতে যে ঋণ করেছে, সেটার সুদ টেনে যেতে হয় এ রেভিনিউ বাজেট থেকেই।

পরিচালনাগত এ ব্যয় এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, সরকার জনগণের কাছ থেকে যত রাজস্বই সংগ্রহ করুক না কেন, সেগুলোর বেশির ভাগই ওই খাতে চলে যাচ্ছে। এ কারণে উন্নয়ন বাজেটের জন্য আশানুরূপ অর্থ বাজেট থেকে পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠছে। অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের জন্য খুব একটা অর্থ পাওয়া যায় না।

কারণ, রেভিনিউ বাজেটে খরচ করার পর যেটা উদ্বৃত্ত থাকবে, সেটাই উন্নয়ন বাজেট হিসাবে খরচ করা হয়ে থাকে। পরিচালনাগত খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ উদ্বৃত্ত কমে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের পরিচালনাগত ব্যয়ের পরিধি কমিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ সরকারের আকার ছোট করতে হবে।

মোট বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা রয়েছে ঘাটতি বাজেট। এই ঘাটতি বাজেটের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ আর বাকি অর্ধেক হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ। ৩-৪ বছর থেকে যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখা যাবে বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে বৈদেশিক উৎসের দেনাও বাড়ছে।

বাজেটে রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংগ্রহ করবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর-রাজস্ব আদায়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং নন-ট্যাক্স রেভিনিউ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর বাকিটা ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি সরকার পূরণ করবে কীভাবে? সরকারকে এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে।

আগে সরকারের ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ সূত্রটি ছিল না। এটা নতুন করে শুরু করছে সরকার। সরকারের ঋণ গ্রহণের একটা মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক খাত, আরেকটা হচ্ছে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেবে সরকার। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৬১ কোটি টাকা বেশি।

চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার অঙ্কটি আমার জানা নেই। তবে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে সেটা অধিক মাত্রায় টাকা ছাপিয়ে এ ঋণ নিতে হবে। এর ফলে টাকার প্রবাহ বাড়বে আর টাকার প্রবাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকবে, যেটা কোনোভাবেই সুখকর হবে না।

এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায়। সেটা হলো-সরকার কখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করে? যখন সরকারি কোষাগারের ডেব্ট বা ঋণ বেড়ে যায়, অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহ করে যখন সরকার ঋণের সুদ আর টানতে পারে না, তখন সরকার ওই সুদ মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করে। এটাকে মানিটাইজেশনও বলে। এ ধরনের পরিস্থিতি সরকারের জন্য খুবই বিপজ্জনক। নিয়ম হচ্ছে, সরকারকে আয়ের অনুপাতেই ব্যয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে। অর্থাৎ আয়ের অধিক ব্যয় করা যাবে না।

ঋণ করে ঘি খেলে যা হয়, অবস্থাদৃষ্টে বর্তমানে আমাদেরও হয়েছে তা-ই। ৫-৬ বছর ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্র দেউলিয়ার মুখে পড়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ঋণ করে ঘি খাওয়ার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ার কিছু দেশ, আফ্রিকার বহু দেশ এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ দেউলিয়ার মুখে পড়েছে। এগুলো বিপদে পড়েছে ঋণ করে ঘি খেতে গিয়েই।

এসব দেশ আইএমএফ প্রোগ্রামের অধীনে থেকেও তাদের অবস্থা বদলাতে পারেনি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, খুব কমসংখ্যক রাষ্ট্রই আইএমএফ-এর প্রোগ্রামের মধ্যে এসে তাদের বেঁধে দেওয়া শর্ত মেনে উন্নতি করেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সুতরাং আমাদের বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে এবং ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবণতা থেকে রেবিয়ে আসতে হবে।

আমাদের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক ঋণ করা এবং বৈদেশিক সূত্র থেকে বিনিয়োগ পাওয়া এক কথা নয়। এ দুয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে থাকে এবং সেটা পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়।

জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে বৈদেশিক মুদ্রায় সরকার ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করে থাকে। আর এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে থাকলে আমাদের রিজার্ভ কমতে থাকবে, যেটা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। পাকিস্তান ও শ্রীলংকা বিপদে পড়েছে বৈদেশিক ঋণের কারণে। পাকিস্তান ও শ্রীলংকার অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তা না হলে আমাদের অবস্থাও তাদের মতো হতে বাধ্য।

বাংলাদেশ ঋণের মধ্যে ডুবে যাওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে খুব দ্রুত। এর লাগাম টানা উচিত। অভ্যন্তরীণ ঋণটা হয়তো কোনো রকমে কাটিয়ে উঠতে পারবে। টাকা ছাপিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু বৈদিশিক ঋণ পরিশোধের বেলায় টাকা ছাপিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ তারা তো বাংলাদেশি টাকা নেবে না।

তাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে ডলারের মাধ্যমে। আমাদের তো পর্যাপ্ত ডলার নেই। আজ ডলারের সংকট কেন হয়েছে? বৈদেশিক ঋণ ও সুদ দেওয়া শুরু হওয়ায় ডলারের সংকট শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানির বিষয়টি। কারণ আমদানি করতে হয় ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বিদেশি মুদ্রায়। সুতরাং এটাও একটা বিশাল বোঝা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এ বোঝার বার্ষিক পরিমাণটা কত, সেটা মিডিয়াও প্রকাশ করছে না। কারণ মিডিয়ার কাছে এর এক্সসেস নেই।

ডলারের সংকটের কারণে আমরা কয়লা আমদানি করতে পারছি না, যার ফলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে পতিত হয়েছে দেশ। গত দুই বছর ধরে আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভে মিস ম্যানেজমেন্ট চলছে। এভাবে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভে মিস ম্যানেজমেন্ট চলতে থাকলে দেশের জন্য সেটা হবে অশনিসংকেত।

একসময় আমরা খুশির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রকল্পে ফরেন এক্সচেঞ্জ খরচ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম, এখন যার খেসারত দিচ্ছে দেশ। উপরন্তু শ্রীলংকাকেও আমরা ঋণ দিয়েছি। সত্য কথা বলতে কী, বৈদেশিক ঋণের বোঝা টানতে টানতে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি নিচের দিকে নামতেই থাকে অথবা ডুবতেই থাকে, তাহলে এটা খুবই চিন্তার বিষয়।

সুতরাং এ বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারের উচিত হবে নতুন করে বৈদেশিক ঋণ না নেওয়া এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে রাখা। সরকারের আকার কমানো। সরকারি সেক্টরে কৃচ্ছ্রসাধন করা। কেউ বলতে পারে, কৃচ্ছ্রসাধনে ডলার তো আসবে না। কথাটি সত্য, ডলার তো আসবে না। কিন্তু সরকারের ঋণের পরিধি কিছুটা হলেও কমবে। (অনুলিখন)

আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews