দুই হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫), বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) পর চতুর্থ স্থানে আসেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)। এ বছর তার জন্মসার্ধশত (১৫০তম) বার্ষিকী।
অবিভক্ত বাংলার জাতীয় নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার জন্য ছিলেন সুপরিচিতি। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। বলা বাহুল্য, সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ফজলুল হক। তার আপসহীন ন্যায়নীতি ও অসামান্য বাকপটুতার কারণে রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন ‘শেরেবাংলা’ (বাংলার বাঘ) কিংবা ‘হক সাহেব’নামে। সর্বভারতীয় রাজনীতির পাশাপাশি গ্রামবাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যেমন তিনি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে সর্বপ্রথম একটি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মুসলমানদের শিক্ষার জন্য তিনি তার যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন এবং মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। বাংলায় দ্বৈতশাসনামলে ১৯২৪ সালে প্রায় ছয় মাসের জন্য তিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দেশে শিক্ষাসংক্রান্ত অবকাঠামো সৃষ্টির উদ্দেশে তিনি বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড গঠন করে তিনি যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের সাহায্য করেন। মুসলমান ছাত্রদের ফারসি ও আরবি শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাংলায় একটি পৃথক মুসলমান শিক্ষা পরিদফতরও গঠন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণেরও তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন। বাংলায় মাদরাসা শিক্ষার নতুন কাঠামো তৈরিতেও তার ভূমিকা ছিল। ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে তার অবদান ছিল সর্বজনবিদিত।
১৯০৬ সালে আইন ব্যবসায় ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ব-বাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে এ কে ফজলুল হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি ১৯১৩ সালে এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি। ওই একই সময়ে পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
দিল্লিতে ১৯১৮ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফজলুল হক। তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি যিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। লক্ষৌ শহরে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, তা ‘লক্ষৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়। ওই চুক্তির অন্যতম একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ফজলুল হক। ওই চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক পর্যায়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন।
১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ কে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় আইনসভায় প্রবেশ করে প্রথম অধিবেশনে ফজলুল হক সারগর্ভ ওজস্বিনী বক্তৃতা দেন, তা আইনসভায় এমন বিস্ময় উদপাদন করেছিল যে বাংলার লাট লর্ড কারমাইকেল সভাপতির উচ্চাসন থেকে নেমে এসে ফজলুল হকের সাথে করমর্দন করেন এবং ভারতের তদানীন্তন সেরা বাগ্মী স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিনচন্দ্র পাল তার বাগ্মিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন। ১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়ার জন্য। তার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই হর্নেল তখন ফজলুল হকের শিক্ষাবিষয়ক উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে বাংলার ‘বেন্থাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ফজলুল হক ১৯১২ থেকে মুসলিম লীগে, ১৯১৪ থেকে কংগ্রেসে, ১৯১৫ থেকে প্রজা আন্দোলন শুরু করে ১৯১৯ সালে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে সম্ভাব্য যাবতীয় উপায়ে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৪ সালে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, অর্থাৎ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে ফজলুল হক এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সম্মেলনে যোগদানকারী ড. শহীদুল্লাহ (১৮৮৪-১৯৬৯) বলেছেন, ‘সে বক্তৃতা না শুনলে ধারণা করা যায় না যে, ফজলুল হকের এক একটি বক্তৃতা বাংলার মুসলমান কতখানি জাগ্রত করেছে এবং এগিয়ে দিয়েছে।’
১৯২৪ সালে তিনি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৩৫ সালে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন এ পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালি মুসলমান। ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৩০ এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পরপর বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে অনুষ্ঠিত ১৯৩০-৩১ সালের প্রথম বৈঠকে ফজলুল হক বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার পর ১৯৩৭ সালে সেখানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ ভারতে প্রজা পার্টি নামে সামন্ততন্ত্রবিরোধী যে দল ছিল ফজলুল হক সেটির রূপান্তর ঘটান কৃষক প্রজা পার্টি নামে রাজনৈতিক দলে। ওই নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে তার দল তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং নির্দলীয় সদস্যদের সঙ্গে জোট গঠন করে, এ কে ফজলুল হক হন অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদের দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে জোর দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ‘ফ্লাউড কমিশন’ গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। ১৯৩৯ সালের ‘বঙ্গীয় চাকরি নিয়োগবিধি’ প্রবর্তন করে মন্ত্রিপরিষদ মুসলমানদের জন্য ৫০ শতাংশ চাকরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে। এ বছরে ‘চাষি খাতক আইন’-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে ‘মহাজনি আইন’ পাস করান। এ বছরই ‘দোকান কর্মচারী আইন’ প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার নির্দেশ জারি করেন। কৃষি আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাটচাষিদের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে ‘পাট অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান ও ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন এ কে ফজলুল হক। এই লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে পরবর্তীকালে পরিচিতি লাভ করে।
লেখক : সাবেক সচিব এবং
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান