ডিম, ডিম্ব, অণ্ড, আণ্ডা—যে নামেই ডাকি না কেন, ডিম ডিমই। খাদ্য হিসেবে ডিমের কোনো তুলনা নেই। ডিম গরিবের খাবার, মধ্যবিত্তের খাবার, এমনকি বড়লোকেরও খাবার। তবে মধ্যবিত্তের খাবার হিসেবে শীর্ষে। হোস্টেল-ছাত্রাবাসগুলোতেও ডিম ছাড়া এক দিনও চলে না। ডিম দিয়ে কী হয়—এই প্রশ্নের চেয়ে ডিম দিয়ে কী হয় না—বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ডিমভাজি, ডিমচপ, ডিমের কোরমা, সেদ্ধ ডিম, ডিমের ভুনা, ডিমের অমলেট, ডিমের পাকোড়াসহ আধুনিক সময়ের এগ চ্যাট, এগ সালাদ কিংবা ডিমের মুত্তা এভিয়াল—কত না রেসিপি! এ কারণে ডিম ডিমই। দেশে পোলট্রি খামারের বিকাশ প্রোটিনের উত্স হিসেবে ডিমকে অনেকটা সহজলভ্য করে দিয়েছে। এখন মাছে-ভাতে না হলেও ডিমে-ঝোলে বাঙালি।
ডিম নিয়ে মজার তর্ক আছে—ডিম আগে, না মুরগি আগে? উত্তর দিতে হিমশিম খেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু উত্তরটা সহজ—ডিম আগে। কারণ, আমাদের অনেকের সকালটা তো শুরু হয় ডিম দিয়েই! তবে ডিম খাওয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। কখনো শোনা যায় ডিম খেলে কোনো অসুবিধা নেই। কখনো বলা হয় সপ্তাহে তিনটির বেশি নয়। কখনো বলা হয়, বয়স যত বাড়বে, ডিম তত কমানো দরকার। কখনো বলা হয়, ডিম খাও যত খুশি, যে বয়সে খুশি, তবে কুসুম ছাড়া। আবার কেউ বলেন, দিনে একটা-দুইটা ডিম খেলে কিছুই হয় না, তা বয়স যতই হোক। এগুলো কোনো সাধারণ কথা নয়, রীতিমতো গবেষণা করে বের করা, পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কথা। কোনটা যে সত্য আর কোনটা অসত্য বলা কঠিন। তবে ডিমখেকোরা এসব গবেষণার তোয়াক্কা না করেই ডিম খেয়ে যাচ্ছে। অকাতরে। বেশুমার।
আমরা সাধারণত মুরগির ডিম বেশি খাই। এর বাইরে হাঁসের ডিমও প্রচলিত। ইদানীং কোয়েলের ডিমও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ডিম কেবল হাঁস-মুরগি-কোয়েলই পাড়ে না। জগতের আরো অনেক প্রাণী পাড়ে। কিন্তু আমরা তা খাই না। মশা পাড়ে, কচ্ছপ পাড়ে, কুমির পাড়ে, সাপ পাড়ে, তেলাপোকা পাড়ে, মাকড়সা পাড়ে, পাখি পাড়ে, হাঁস পাড়ে—জগতের আরো অনেক প্রাণী পাড়ে।
আমাদের জীবনে আরো একটা ডিম আছে—ঘোড়ার ডিম। ব্যঙ্গার্থে এ দুটি শব্দের এন্তার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। জীবনযুদ্ধে পরাস্ত, সংসার রোগে আক্রান্ত বাঙালির ঘরে ঘরে যে কতিপয় কথা ঘন ঘন শোনা যায়, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রথমে ‘আল্লাহ-খোদার নাম’, দ্বিতীয় ‘ধুর ছাই’ ও তৃতীয় হইল ‘ঘোড়ার ডিম’।
শৈশব থেকে শুনতে অভ্যস্ত, কোনো দিন কেউ এর গভীরে যাইনি, কেউ অনুসন্ধান করে বের করেনি যে ‘ঘোড়ার ডিম’ প্রকৃত কী বস্তু। আমাদের যুগে ছিল ‘কৌতুক বেশি কৌতূহল কম’, কিন্তু বর্তমান যুগের ধারা যে বিপরীত। এখন অনেকেই কৌতূহল দেখায়। হোটেলে গিয়ে যদি বলেন, ‘একটা ডিম দাও,’ অমনি প্রশ্ন আসবে, ‘হাফ বয়েল, মামলেট, পোচ, অমলেট, ঝুরি না ঝোল?’
আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, অনেক সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বসে বসে ডিম পাড়তে এবং ডিমে তা দিতে পছন্দ করেন। তবে এটা বাস্তবে গোলাকার কোনো ডিম নয়; এটা হলো ঘোড়ার ডিম। সমস্যা হলো, এই ঘোড়ার ডিম চোখে দেখা যায় না, মামলেট করেও খাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সুবিধা হলো, এই ডিম পচার বা নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।
নাসির উদ্দিন হোজ্জাকে রাজসভা থেকে বের করে দিয়েছেন রাজা। কদিন পর ভাবলেন, হোজ্জাকে ডেকে এনে আরো কিছুটা অপমান করা যাক। রাজা ডাকলেন তাকে আবার। রাজ্যসভায় সবার সামনে বললেন, ‘হোজ্জা, তুমি নাকি খুব বুদ্ধিমান। এবার বলো তো, দুটো জিনিস আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আছে মনে করে প্রায়ই কথায় কথায় উচ্চারণ করি। জিনিস দুটো কী?’
মাথা চুলকিয়ে হোজ্জা বললেন, ‘হুজুর, ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?’
‘নির্ভয়ে বলো।’
কদিন আগে রাজা তাকে অপমান করেছেন সবার সামনে। হোজ্জা দেখলেন, রাজাকে অপমান করার এই সুযোগ; প্রতিশোধ নেওয়ার এই তো সময়। তিনি নির্ভয়েই বললেন, ‘একটা আপনার মাথার মগজ, আরেকটা ঘোড়ার ডিম।’
ডিমের বদনামও কম নয়। সন্তান পরীক্ষা দিতে যাবে। মা কিছুতেই ডিম খাওয়াবেন না। তার ধারণা, ডিম খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভালো হবে না, ডিম পাবে। যদিও এর কোনো ভিত্তি নেই। পৃথিবীর সব দেশের জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতেরা ডিম খেয়েই পরীক্ষা দিতে গেছেন। তাতে রেজাল্টে কোনো হেরফের হয়নি।
আপনার কাছে যদি দুটো ডিম থাকে, তাহলে আপনি কী করবেন? ভেজে খেয়ে ফেলবেন? বাচ্চা ফুটানোর জন্য তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন? না অন্যকে দিয়ে দেবেন? যা-ই করুন, ওটা একান্তই আপনার ব্যাপার। যদি অন্যদের হাতে দুটো ডিম থাকে, তাহলে তারা কী করবে? এ ব্যাপারে একটা প্রচলিত গল্প রয়েছে।
আমেরিকান রাজনীতিবিদ :দুটো ডিমের একটা বিক্রি করে দেবেন। তারপর সামরিক অভিযানের ভয় দেখিয়ে আরেকটা ডিমকে চারটা ডিমের সমান হতে বলবেন, চারটা কুসুমও রাখতে বলবেন তাতে।
চীনা অর্থনীতিবিদ :তারা ডিম দুটোকে দশ ভাগের এক ভাগ ছোট করে ফেলবেন। কিন্তু সেটা ভাঙলেই ফুটবলের মতো বড় একটা কুসুম বের হয়ে আসবে সেখান থেকে। তারপর সারা বিশ্ব একচেটিয়া বাজারজাত করবে এটা।
বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ :ডিম দুটো যেমন ছিল তেমনই থাকবে। বিদেশ থেকে আরো দুটো ডিম উচ্চমূল্যে এবং শর্তসাপেক্ষে কিনে আনবেন আরো অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা বলে। এ বাবদ বিশাল টাকার বাজেট করা হবে। বিদেশ থেকে আনা ডিম দুটো নতুন পরিবেশে নষ্ট হতে থাকবে হঠাত্। তাদের ভালো রাখার জন্য এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে একজন দক্ষ পরামর্শক নিয়োগ ও চারজন কেয়ারটেকার আনা হবে। এ বাবদ আরো বিশাল অঙ্কের বাজেট হবে। অন্যদিকে, নিজের ডিম দুটো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে একদিন!
আজকের একটি ডিম কালকের একটি মুরগির চেয়ে অধিক উত্তম বলেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন। ডিম যে মানুষকে কেবল পুষ্টি দেয় তা নয়, আরো উপকার করে। যেমন খারাপ নাটক, খারাপ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পণ্ড করতে বা নিজেদের আপত্তি জানাতে ডিম ছুড়ে মারা হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য বিশুদ্ধ ডিম দিয়ে কাজটি হয় না। প্রয়োজন হয় পচা ডিমের। পচা অভিনেতা, পচা শিল্পী, পচা বক্তার জন্য পচা ডিম। দর্শক গ্যালারি থেকে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দিতে হয় পচা ডিম। পচা ডিমের কাজ এখানেই শেষ নয়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের প্রতিও প্রতিপক্ষ কিংবা বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ডিম ছুড়ে মারেন।
যা হোক, আমাদের দেশে আবারও ডিম আলোচিত হয়ে উঠেছে। এর কারণ দাম। স্থানভেদে ডিমের দাম ৫০-৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ একে অবশ্য বলছেন পানির দামে ডিম বিক্রি। কারণ হাফ লিটার বোতলজাত পানির দাম ১৫ টাকা। একটা ডিমের দামও ১৫ টাকা। সেক্ষেত্রে ‘পানির দামে ডিম বিক্রি’ কথাটা মিথ্যে নয়!
আমাদের দেশে যখন চালের দাম বাড়ে, তখন বলা হয়—‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান।’ সয়াবিনের দাম বাড়লে সরিষার কথা বলা হয়। বেগুনের দাম বাড়লে মুলার কথা বলা হয়। আমের দাম বাড়লে কাঁঠালের কথা বলা হয়। ডিমের দাম বাড়লে বিকল্প হিসেবে কী খেতে বলা হবে? ঘোড়ার ডিম?
ডিমের দাম বাড়ছে, সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে একশ্রেণির করপোরেট ব্যবসায়ী ফুলেফেঁপে উঠছেন। কিন্তু মুরগি কিংবা হাঁসগুলো ঠিকই নিয়ম করে ডিম দিয়ে চলেছে। তাহলে ডিমের দাম বাড়ছে কেন? কারণ আমাদের দেশে ‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাসে’। প্রশ্ন হলো, এই ‘বাগডাস’দের হাত থেকে আমাদের কে রক্ষা করবে?
পুনশ্চ :পরিশেষে একটি পুরোনা কৌতুক।
এক কৃপণ গৃহস্থ একবার ক্ষেপে গিয়ে তার সব মুরগিকে বললেন, আগামীকাল থেকে যদি প্রতিদিন দুইটা করে ডিম না দিস, তাহলে ধরে জবাই করে খেয়ে? ফেলব! এরপর থেকে প্রতিটি মুরগিই প্রতিদিন দুইটা করে ডিম দিতে লাগল। শুধু একটা বাদে! ঐটা প্রতিদিন একটা করেই ডিম পাড়তে লাগল।
গৃহস্থ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, কি রে! তোর তো সাহস কম না! এত বড? হুমকি দিলাম, এর পরও একটা করে ডিম পারছিস!
সেই মুরগির জবাব :জনাব! আপনার ভয়ে তাও তো বহু কষ্টে একটা করে ডিম পাড়ছি! আমি যে আসলে মোরগ!
লেখক: রম্যরচয়িতা