অপরিণামদর্শী মানুষ তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ ঘটিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পরিবহন। বাস, ট্রাক, কার, মোটরসাইকেলের হর্ন অনবরত শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে।
স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থানেও এসব যানবাহনের তীব্র শব্দের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। এ ছাড়া রেলস্টেশনের ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ৯০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে, যা মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে।
অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সময় জেনারেটর ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। প্রচারের কাজে, সভায় বক্তৃতাকালে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারেও শব্দদূষণ হয়। আতশবাজির শব্দে তীব্র শব্দদূষণ ঘটে।
শব্দের উৎসের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষই শব্দদূষণ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। মানবদেহে উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। শব্দদূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষের শ্রবণশক্তির অস্থায়ী বা স্থায়ী যে কোনো ধরনের ক্ষতি হতে পারে, যা কালক্রমে শ্রবণশক্তিহীনতা থেকে বধিরত্বে রূপ নিতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, তীব্র শব্দ পরোক্ষভাবে মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন, উচ্চমাত্রার শব্দ হৃদরোগ, রক্তচাপ বৃদ্ধি ইত্যাদি রোগের কারণ হতে পারে।
উচ্চশব্দ মস্তিষ্কের কোষের ওপর অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া এবং মাথা ধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এমনকি উচ্চমাত্রার শব্দ আংশিক বা পূর্ণ বধিরতারও কারণ হতে পারে। শব্দদূষণ মানবদেহের রক্তের শর্করার ওপর প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণে রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। উচ্চমাত্রার শব্দে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।
শব্দদূষণ রোধে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রযুক্তিগত ও আইনগত কিছু পদক্ষেপ। বাড়িঘরে বিনোদনে ব্যবহৃদ রেডিও-টেলিভিশনের শব্দ যথাসম্ভব কমিয়ে শুনতে হবে। পেশাগত কাজে শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতিতে শব্দ প্রতিরোধক যন্ত্র লাগিয়ে নিতে হবে। আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃদ লাউড স্পিকারের শব্দ সীমিত রাখতে হবে। যানবাহন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, কলকারখানা থেকে যে অনাকাক্সিক্ষত উচ্চশব্দ উত্থিত হয়, তা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব।
শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃদ যন্ত্রপাতি উন্নত প্রযুক্তির ও মানসম্পন্ন হলে তা থেকে অপেক্ষাকৃত কম শব্দ তৈরি হবে, যা শব্দদূষণ রোধে সহায়ক হবে। উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রে শব্দ প্রতিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করা হলে তা থেকে আর শব্দদূষণ হবে না। এ ছাড়া অহেতুক হর্ন বাজানো বন্ধ করা দরকার।
শব্দদূষণ রোধে সমষ্টিগত উদ্যোগের বিকল্প নেই। তবে ব্যক্তিগত উদ্যাগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও শব্দদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজারের মতো জায়গায় নিচু স্বরে কথা বলার অভ্যাস করা দরকার।
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে নগরায়ন, যানবাহন চলাচলে উচ্চমাত্রার শব্দ নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানার উৎপাদনের ক্ষেত্রে কম শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার এবং সার্বিক পরিবেশসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সুরবর্জিত শব্দ-সঞ্চারণ নিয়ন্ত্রণ করে শব্দদূষণ অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ : প্রাবন্ধিক