তারুণ্যে এক টিকিটে দুই সিনেমা দেখার আকর্ষণ ছিল দুর্ণিবার। সুযোগ পেলে তা কখনো হাতছাড়া করা হতো না। তেমনি পরবর্তী জীবনে এক যাত্রায় অনেক ফল লাভের ঘটনা ঘটেছে বহুবার। সেসবের মধ্যে একটি হলো, জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে লেবানন ও কুয়েত ভ্রমণ। দুই দেশে আমাদের সেনা ও নৌবাহিনীর কার্যক্রম দেখতে যাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ভিসা বিড়ম্বনায় যাত্রাটাই ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে পাসপোর্টের স্ক্যান কপি পাঠানো হয়েছিল ঢাকার কুয়েত দূতাবাসে। কিন্তু যাত্রার দুই দিন আগপর্যন্ত ভিসার কনফার্মেশন পাওয়া যায়নি। একদিন বারিধারায় কুয়েত দূতাবাসে ঘুরে আসা হলো। কোনো সুসংবাদ পাওয়া গেল না। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলাম। সেখানকার মধ্যপ্রাচ্য ডেস্কের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বললেন, এরা হলো জাতহারামি। দেখবেন, ভিসা আসবে আপনারা চলে যাওয়ার পর। শেষ পর্যন্ত কুয়েতের ভিসা ছাড়াই দুদেশের উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। রিটার্ন টিকিট করা ছিল। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে লেবানন। সেখান থেকে কুয়েত-দুবাই হয়ে ঢাকায় ফেরা। কিন্তু কুয়েতের ভিসার খবর নেই। সফরসঙ্গী সেনা কর্মকর্তা বললেন, চিন্তার কিছু নেই। আমরা লেবানন অবস্থানের মধ্যেই ভিসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যেহেতু অনলাইন ভিসা, সেটা আমরা ইমেইলেই পেয়ে যাব। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছিল।

কুয়েতের রাস্তায় বিশ্বের সব ধরনের দামি গাড়ির ছড়াছড়ি। কুয়েত সিটিতেও চার থেকে আট লেনের রাস্তা। গাড়ির গড় গতিসীমা ১০০ কিলোমিটার। ১৪০-১৬০ কিলোমিটারেও গাড়ি চলে ফাঁকা হাইওয়েতে। চালকদের অন্তত ৪০ ভাগ নারী। এ নারী চালকরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, মহিলা চালকরা মোবাইল ফোন টেপে আর হাইস্পিডে গাড়ি চালায়। সামনে কিংবা ডানে-বাঁয়ে তাকানোর সুযোগ নেই তাদের। কাকে কখন চাপা দিয়ে মারবে তার কোনো ঠিক নেই। তিনি বলেন, গত বছর আমরা দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২০০ জন প্রবাসীর লাশ দেশে পাঠিয়েছি। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা সর্বাধিক।

বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ বিস্তারের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে নিরাপত্তা সতর্কতা তারই আলামত দেখা গেল কুয়েত এয়ারপোর্টে নেমে। তল্লাশি কত প্রকার টের পাওয়া গেল। ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম সারতে সহায়তা করেন আমাদের সেনাসদস্যরা। কুয়েতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান (পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব) বললেন, আপনাদের ভিসার জন্য অনেক খাটতে হয়েছে। কুয়েতে বাংলাদেশি সেনারা শুধু মাইন অপসারণই নয়, দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায়ও নিয়মিত বাহিনীর অংশ হয়ে কাজ করছেন। কুয়েতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও বাংলাদেশের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব। কুয়েত থেকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার তেল কেনে বাংলাদেশ। কুয়েতে মূলত কৃষিজাত পণ্য, নিটওয়্যার, হিমায়িত খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। কয়েক বছর হলো কুয়েতে ওষুধ রপ্তানি করছে বেক্সিমকো ফার্মা। কুয়েত সিটিতে থাকেন আমাদের দসিনা লাবণী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রয়াত চেয়ারম্যান ড. দেলোয়ার হোসেন স্যারের মেয়ে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী। ব্যাচমেট। কুয়েত ট্যুরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একটা আড্ডা দেওয়া হলো না- এ আফসোস রয়েই গেল। কঠোর শিডিউল আর নিরাপত্তার ঘোরটেপে বন্দি ছিলাম কটা দিন। আহা, লাবণী, আমাদের সুন্দরী বান্ধবী। তাঁর লাবণ্য এই পঞ্চাশে এসেও এতটুকু কমেনি। তাঁর ফেসবুকজুড়ে শুধু ঘুঘুর ছবি।

কুয়েত সিটিতে ‘কুয়েত হাউস অব ন্যাশনাল মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’-এর মেঝেতে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কর্তিত মস্তক রাখা আছে। দর্শনার্থীরা যখন মিউজিয়ামের পথ ধরে হেঁটে যায় তখন তারা দেখতে পায়, গলা কাটা সাদ্দাম তার পায়ের কাছে রাখা আছে। কুয়েতিদের কাছে সাদ্দাম হোসেন এক ঘৃণিত নাম। সাত মাসের দখলদারত্বে সাদ্দাম কুয়েতের অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন। দেশটির প্রায় ৭০০ তেলক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কুয়েতের প্রায় ৬০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে মাইনসহ ভারী অ্যামুনেশন (গোলাবারুদ) ডাম্প করে রাখে সাদ্দামের বাহিনী। বাংলাদেশি সেনাসদস্যরা কুয়েতের বিস্তৃত মাইনফিল্ডে জীবনবাজি নিয়ে ২০০২ সালের মার্চ থেকে মাইনসহ ভারী যুদ্ধাস্ত্র অপসারণের কাজ শুরু করেন। সেই মাইন অপসারণে  ২২ বছর ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্য। এর পাশাপাশি তাঁরা কুয়েত পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বর্তমানে ৫ হাজারের বেশি সেনাসদস্য ‘অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন-ওকেপি’-এর আওতায় সেখানে কাজ করছেন।

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন যখন বিনা উসকানিতে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট মধ্যরাতে ১ লাখ সৈন্য ও ৩০০ ট্যাংক নিয়ে কুয়েত সীমান্ত অতিক্রম করেন, তখন কুয়েতের ১৬ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রতিরোধের চিন্তার চেয়ে দুপাশে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। তখন কে ভেবেছিল সেই সাদ্দামের হামলাযাত্রায় বাংলাদেশের জন্য শুভফলও বয়ে আসতে পারে। এ দখলদারত্বের অবসান ঘটে ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কুয়েতকে বৈদেশিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে বহুজাতিক বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়, যা দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। যুদ্ধের পর থেকে অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠনের আওতায় গত ৩৩ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কুয়েত সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে।

মাত্র ১৭ হাজার ৮১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুয়েতে নিজ দেশে ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে কুয়েতিরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের তুলনায় উপসাগরীয় দেশ কুয়েতে ভারতীয়র সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর কুয়েতে প্রবাসী শ্রমিকদের তালিকায় শীর্ষে ছিল ভারতীয়রা। যা কুয়েতের মোট কর্মশক্তির প্রায় ২৫ শতাংশ। গালফ নিউজের এক  প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, কুয়েতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৮ লাখ। এর মধ্যে কেবল বিদেশিই আছেন অন্তত ৩৩ লাখ। দেশটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কারণে কুয়েতিরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কুয়েতের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে কুয়েতে ভারতীয় কর্মীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজারে পৌঁছেছে। সর্বশেষ এ পরিসংখ্যানে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা ২০২৩ সালের চেয়ে প্রায় ১৮ হাজার বেড়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮০০ জনে পৌঁছেছে; যা কুয়েতের মোট কর্মশক্তির প্রায় ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত কুয়েতের বিদায়ি রাষ্ট্রদূত ফয়সাল মুতলাক আলাদওয়ানি গত ৩ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেছেন, কুয়েতে ৩ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন এবং তার দেশ আরও বাংলাদেশি নিয়োগ দিতে আগ্রহী। কুয়েতপ্রবাসী একাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জানান, কুয়েত যেভাবে উন্নতি করেছে সেখানে অভিবাসী ছাড়া কোনোভাবেই চলতে পারবে না তারা। তাদের সিস্টেম সচল রাখতেই বিপুলসংখ্যক অভিবাসী দরকার। এজন্য কুয়েতের শ্রমবাজার সব সময়ই সচল থাকবে। সেটি আমরা কতটা নিজেদের পক্ষে নিতে পারি সেটাই মূল বিষয়।

ভারতীয়রা দারুণ ব্যবসা করছে কুয়েতে। ব্যবসায় আমাদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। সেখানে একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন লক্ষ্মীপুরের পাপুল। টাকাপয়সা হয়ে যাওয়ার পর রাজনীতির ভূত চাপে তাঁর মাথায়। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর আরেক চমক ছিল পাপুলের স্ত্রীর সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হওয়া। সবকিছুই ঘটেছিল টাকার জোরে। এরপর এই এমপি আবারও আলোচনায় আসেন মানব পাচারের অভিযোগে। কুয়েতের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে জালজালিয়াতি আর ভিসা বাণিজ্যে বছরে পাপুলের নেট প্রফিট ছিল ২ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার। মানব পাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারে অভিযুক্ত হিসেবে এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে ২০২০ সালের ৬ জুন দেশটির ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডি আটক করে। কুয়েতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করা পাপুল তখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে পাঠিয়ে ৫ কোটি কুয়েতি দিনার (প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি) হাতিয়েছেন। পরে এমপি পাপুলের ৫ কোটি কুয়েতি দিনার জব্দ করা হয়। ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় পাপুলের চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন সে দেশের আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে ৫৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

কুয়েত সফরকালে সেই শহীদুল ইসলাম পাপুলের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় তাঁর সুপার স্টোরে। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের পত্রিকায় তাঁর যেন একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। কিন্তু আমাদের কাছে তাঁর সে চাওয়ার কোনো সংবাদমূল্য ছিল না। অবশ্য আমরা তাঁর বিশাল ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানতামও না। পরের বছরই দেখি, এক টিকিটে দুই সিনেমা দেখার মতোই তিনি স্ত্রীসহ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আইনপ্রণেতা হয়ে গেছেন। কুয়েতি দিনারের এতই ক্যারিশমা!

আসলেই কুয়েতি দিনারের অনেক ক্যারিশমা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হচ্ছে কুয়েতি দিনার। ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকরেটে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ১২০ টাকা। অথচ প্রতি কুয়েতি দিনার কিনতে লাগে ডলারের ৩ গুণের বেশি, ৩৯০ টাকা। বাহরাইনি দিনার ৩১১ টাকা। ওমানি রিয়াল ৩০৪ দশমিক ৮৩ টাকা, জর্ডানিয়ান দিনার ১৬৫ টাকা, ব্রিটিশ পাউন্ড ১৪৯ টাকা। মাঝখানে আরও কয়েকটি দেশের মুদ্রা পেরিয়ে ইউরোর বিনিময়মূল্য ১২৭ টাকা। অর্থাৎ ছোট দেশ হলেও সে দেশের মুদ্রার মান অনেক বেশি। শান্তিপ্রিয় এ দেশটি ইসরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকলেও জোরালো কোনো ভূমিকায় দেখা যায়নি তাদের। অবশ্য তাদের সেই সামরিক সক্ষমতাও নেই।

লেখক : সাংবাদিক

ইমেইল : [email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews