আপডেট: ১৭ নবেম্বর ২০১৮ - ০৬:২৬ | প্রকাশিত: শনিবার ১৭ নবেম্বর ২০১৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ জাপান। আণবিক বোমার আঘাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর জাপানিরা মাত্র কয়েক বছরে পূর্বাবস্থায় ফেরাতে সক্ষম হন। কিন্তু কীভাবে? চলুন দেখা যাক তাঁদের ঘুরে দাঁড়াবার কারিশমা।
জাপানের ছাত্ররা রোজ তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে পনেরো মিনিট নিজেদের স্কুল পরিষ্কার করেন; যা তাঁদের একটি পরিচ্ছন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
একটি অবাক হবার মতো ব্যাপার যে, জাপানে ময়লা-আবর্জনা সাফকারীদের ‘হেলথ ইঞ্জিনিয়ার’ বলা হয়। তাঁরা ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার ডলার পর্যন্ত মাসিক বেতন পান। আর আমরা তাদের বলি ‘মেথর’। খুব বেশি হলে সুইপার, ক্লিনার। এইতো?
জাপানিরা রাস্তায় ময়লা ফেলেন না। ধূমপায়ীরা ব্যাগে করে ছাইদানি নিয়ে ঘোরেন। জাপানের রাস্তায় সিগারেটের পুচ্ছ দূরের কথা, ছাই পর্যন্ত ফেলা বারণ। ফেললে জরিমানা। ফলে বিশ্বজুড়ে জাপানিরা পরিচ্ছন্ন জাতি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
উল্লেখ্য, জাপানের কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। প্রতিবছর অসংখ্য ভূমিকম্প হয়। বলা যায়, প্রায় প্রতিদিনই। তবু দেশটি অর্থনীতিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্থান দখল করে আছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা মারবার মাত্র ১০ বছরে শহর দুটো আগের জায়গায় ফেরে। এ কি কম কথা?
মোবাইল নিয়ে ফাটাফাটির যুগে জাপানের রেস্টুরেন্ট ও ট্রেনে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শিক্ষাজীবনের প্রথম ৬ বছর শেখানো হয়  নৈতিকতা এবং কীভাবে মানুষের সঙ্গে চলতে হয়।
বিশ্বের একটি ধনী দেশ হয়েও সেখানে কোনও কাজের লোক রাখা হয় না। সকল কাজের দায়িত্ব মা-বাবারাই সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবনের প্রথম ৩ বছর কোনও পরীক্ষা হয় না। কারণ তারা মনে করেন লেখাপড়া চরিত্রগঠনের জন্য। পরীক্ষা নেবার জন্য নয়।
জাপানিরা খাবার অপচয় করেন না। রেস্টুরেন্ট অথবা বাসায় যেখানেই হোক,  যার যতটুকু দরকার তার বেশি প্লেটে নেন না।
উল্লেখ্য, জাপানের ট্রেন দেরি করে আসবার গড় সময় বছরে মাত্র ৭ সেকেন্ড। চিন্তা করা যায়? তাঁরা প্রতিটা সেকেন্ডের হিসেব করে চলেন। আমাদের ট্রেন কখনও কখনও পরের দিনও আসে না।
শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য আধ ঘন্টা বিরতি দেয়া হয় সঠিক হজমের জন্য। কারণ তাঁরা এদের জাতির ভবিষ্যত মনে করেন। তাই এদের প্রতি মনোযোগ বেশি দেয়া হয়। যত্ন করা হয়।
দীর্ঘজীবী মানুষের তালিকায়ও জাপানের অবস্থান তৃতীয়। গড়ে প্রায় ৮৩ বছর বাঁচেন জাপানিরা। খান পরিমিত। তাই গড় আয়ু বেশি।
জাপানিদের আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি। সম্মানের খাতিরে জীবন বিলিয়ে দেবার অনেক উদাহরণ রয়েছে দেশটিতে। জাপানের বেশ কয়জন প্রধানমন্ত্রী অল্প কয়টি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। কথা দিয়ে কথা রক্ষার ব্যাপারে তাঁরা খুব সচেতন ও কঠোর।
টাইটানিক জাহাজডুবি থেকে কয়েক জন জাপানি বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন বটে। কিন্তু দেশে ফিরে তাঁরা প্রবল জনরোষের সম্মুখীন হন। ‘সহযাত্রীদের বাঁচাতে যদি না-ই পারলে, তবে তাদের সঙ্গেই প্রাণ দিলে না কেন!’ এই ছিল জনতার আক্ষেপ। মানুষের ধিক্কারের ভয়ে টাইটানিক থেকে বেঁচে আসবাব কথা অনেকেই গোপন করেছিলেন।
নির্ধারিত সময়ের পরও কাজ করার জন্য 'ওভারটাইম' নামে একটি শব্দ প্রচলিত আছে দুনিয়াজুড়ে। কেবল জাপানে এই শব্দটির কোনও অস্তিত্ব নেই। জাপানিরা স্বভাবগতভাবেই অফিসের সময় শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘসময় পড়ে থাকেন কাজ নিয়ে। ঘরে ফেরার তাড়া থাকলেও ঊর্ধতন কর্মকর্তার আগে অফিস ত্যাগের কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারেন না তাঁরা।
সাধারণত আমাদের দেশে অফিসে ঘুমোনো খুবই খারাপ মনে করা হয়। কিন্তু জাপান এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অফিসে ঘুমোলে ভাবা হয় ঘুমন্ত ব্যক্তির ওপর কাজের প্রচুর চাপ ছিল। তখন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি খারাপ না হয়ে আরও উজ্জ্বল হয়।
অনেক সময় সমস্যা মোকাবিলায় অথবা আরামের জন্য এক বিছানায় একাধিক লোকের ঘুমোবার প্রবণতা দেখা যায়। জাপান এ ধরনের সমস্যার মোকাবিলায় ক্যাপসুল হোটেল তৈরি করে থাকে, যেখানে শুধু একজনের সমান জায়গা রয়েছে। উল্লেখ্য, ক্যাপসুল হোটেল শুধু ছেলেদের জন্য তৈরি করা হয়।
জাপান অনেক উন্নত দেশ। হয়তো ভাবতে পারেন তাদের জমি অনেক ঊর্বর। সেখানে প্রচুর ফসল ফলে। কিন্তু আসলে তা নয়। জাপানে শতকরা ৭০ ভাগ ভূমি হচ্ছে পাহাড়পর্বতময়। জাপানে ২০০ এর মতো আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ওগুলোতে প্রায়শ অগ্নুৎপাত হয়।
সন্তান দত্তক বা পালক সন্তানগ্রহণের প্রথা পুরো বিশ্বেই রয়েছে। জাপানে মোট দত্তকগ্রহণের শতকরা ৯৮ ভাগের বয়স ২০-৩০ বছর। অর্থাৎ তারা বয়স্কদের দত্তকগ্রহণ করেন। ব্যবসায়িক পরিবারে যদি পুত্রসন্তান না থাকে, তখন তাঁরা দত্তক নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে যদি নিজের ছেলে বাবা-মা রাখতে অক্ষম হন তখন অন্য একজনের ছেলে নিয়ে আসেন।
জাপানে শ্রমআইন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো। এজন্য কোনও কোম্পানি চাইলেই তার কর্মী ছাঁটাই করতে পারে না। মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হয়। তাই বলে কোম্পানির মালিক পক্ষরাও কিন্তু কম যান না। তাঁরা যে কর্মীকে ছাঁটাই করতে চান তাকে বিরক্তিকর কাজ করতে দেন। হতে পারে সারাদিন টিভি পর্দার সামনে বসিয়ে রাখা। এর জন্য আবার আলাদা শাস্তিকক্ষের ব্যবস্থা রয়েছে।
বলে রাখা ভালো, জাপানে স্বাক্ষরতার হার শতকরা ১০০ ভাগ। অর্থাৎ সেখানে নিরক্ষর বা মূর্খ বলে কেউ নেই।
তাদের পত্রিকায় আমাদের দেশের মতো দুর্ঘটনা, রাজনীতি, সিনেমার খবর ছাপানো হয় না। সেখানে শুধু প্রয়োজনীয় ও আধুনিক জগত সম্পর্কে খবর ছাপা হয়ে থাকে।
জাপানে প্রতি ২ লাখের মধ্যে একজন খুন হবার রেকর্ড আছে মাত্র। অথচ আমাদের দেশে প্রতিদিন অসংখ্য খুনের ঘটনা ঘটছে।
ভাই ভাইকে, বাবা ছেলেকে, ছেলে মা-বাবাকে পর্যন্ত খুন করে বসছে। সব তথ্য ইনটারনেট থেকে নেয়া।
জাপান কোনও মুসলিমদেশ নয়। বৌদ্ধ ও খৃস্টানের দেশ। মুসলিম আছেন খুব অল্পসংখ্যক। কিন্তু মারামারি নেই। খুনোখুনি নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক ঝগড়াও নেই। মানুষের কাজ আর কাজ। দম ফেলার উপায় নেই। সময় নষ্ট করে না কেউ। অন্যের নিন্দে বা বদনাম করবার সময় কই মানুষের?
জাপানিরা বিশ্বকে অনেক কিছুই শেখাচ্ছেন। এশীয় হিসেবে এটা আমাদেরও গৌরব। কিন্তু এশিয়াতে তো অন্যরাও আছেন। বিশেষত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর উম্মত বা অনুসারীরাও রয়েছেন। তাঁরা প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ। কিন্তু সবার শীর্ষে অবস্থান নিতে পারছেন না কেন? দিনদিন শুধু পিছিয়ে পড়ছেন তাঁরা। অতীতের মুসলিমরা কিন্তু এমন ছিলেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতিতে তাঁরা অমূল্য অবদান রেখেছেন। আজ তাঁরা প্রায় পথহারা। বেভুল। তাঁদের অবনতির দিকে তাকানো যায় না। মুসলিমদের যে সম্পদ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা তা অন্যরা লুটে নিচ্ছে। স্বেচ্ছায় দিয়েও দিতে হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক অন্যের দখলে। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থাও ভালো না। ইসরাইল ছড়ি ঘুরোচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা মার খাচ্ছেন প্রতিদিন। কেন?
বাংলাদেশ আকার-আয়তনে ছোট হলেও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এখানে শুধু কয়লা আর গ্যাসই নেই, তেলও আছে। সোনা আছে। পাথর আর কয়লা তুলতেই চিন, জাপান, রাশিয়ার কাছে ধর্না দিতে হয়। তেল আর সোনা তুলবো কার সাহায্য নিয়ে? যাকে আনবো তারাইতো সিংহভাগ নিয়ে যাবে। সৌদি আরব, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারছে না। তলেতলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ অন্যরা টেনে নিচ্ছে কিনা তাও আমরা ধরতে পারি না। আমরা রাজনীতি নিয়ে মারামারি করি। গদি নিয়ে টানাহেঁচড়া করি। প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করি। চক্ষুশূল ভাবি। পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটি। জাপানিরা এসব করেন না। তাই তাঁরা এগোচ্ছেন দেশ জাতিকে ভালোবেসে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করে। আমরা করছি ঝগড়া। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আর এজন্য পড়ছি পিছিয়ে।
দেশ ও জাতির উন্নয়নে আমাদের ঐক্য নেই। সমঝোতার অভাব তীব্র। অথচ মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবার কথা শিশাঢালা প্রাচীরের মতো। টেকসই ভবনের দেয়ালে সেঁটে দেয়া ইটসমূহের যে পরম্পরা ঐক্য এবং সুদৃঢ় সম্পর্ক তাও আমাদের নেই। তাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করে লেখেছিলেন-
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখনও বসে;
বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজি
কুরআন ও হাদিস চষে।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews