আধুনিক বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শামসুর রাহমানের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সৃষ্টি ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে দিয়েছে সমকালীন বাংলা কবিতার প্রধানতম কবির মর্যাদা। কবি হিসেবে দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাকে নাগরিক কবিও বলা হয়।
শামসুর রাহমান ৫০-এর দশকের অগ্রগণ্য কবি। এই দশকের কবিরা ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুনত্ব যুক্ত করেন।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের পরপরই তিনি সচেতন পাঠকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার পরবর্তী গ্রন্থগুলো পাঠকদের ক্রমেই তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। তার চতুর্থ গ্রন্থ ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব স্বর ও শিল্পবোধের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কবিতায় নাগরিক জীবন ও গ্রিক মিথের সুনিপুণ ব্যবহার আছে।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, প্রতিদিন মিছিল-মিটিং হচ্ছে, আপামর জনসাধারণের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যখন প্রশ্নহীন— শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষা ও বিষয়েও তখন পরিবর্তন আসে। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। তার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যেন সচিত্র রূপ পায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসুর রাহমান সপরিবারে তাদের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে চলে যান। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বেদনামথিত হয়ে লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’সহ বেশকিছু কবিতা। তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি যেন সন্তের মন্ত্রোচ্চারণের মতো অনিবার্য, আবহমান বাংলার সাধারণ জীবনের মতো স্বচ্ছন্দ্য।
স্বাধীনতার পর পচাত্তর-পরবর্তী পট পরিবর্তনে আশাহত কবি সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে তার কলম চালিয়েছেন নিরন্তর। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনিমার্ণের আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন সবগুলো আন্দোলন সংগ্রামের শুভ্র পুরুষ। এ কারণে নিজের বাড়িতে তিনি ঘাতকের হাতে আক্রান্তও হন।
কবি শামসুর রাহমানের ষাটের অধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। শিশুতোষ, অনুবাদ, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মস্মৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিজ বাসভূমে, বন্দি শিবির থেকে, ঝর্ণা আমার আঙ্গুলি, স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার, খুব বেশি ভাল থাকতে নেই, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, মাতাল ঋত্বিক, হৃদয় আমার পৃথিবীর আলো, ধ্বংসের কিনারে বসে, আকাশ আসবে নেমে, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, এক ধরনের অহংকার, শূন্যতায় তুমি শোক সভা, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, ইকারুসের আকাশ, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি, নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে, না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি। তার মোট কবিতার বই প্রায় ৬০টি। চারটি উপন্যাস, আটটি শিশুতোষ গ্রন্থ, একটি গল্প গ্রন্থ ও কলাম গ্রন্থ একটি। অনুবাদ করেছেন শেকস পিয়রের হেমলেট।
সাংবাদিকতাই ছিল তার পেশা। ডেইলি মর্নিং নিউজের মাধ্যমে শুরু ১৯৫৭ সালে। ১৯৭৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক, পরে প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন অধুনার সম্পাদক, প্রধান সম্পাদক সাপ্তাহিক মূলধারা এবং কবিকণ্ঠেরও একজন সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার জন্ম ঢাকার মাহুতটুলিতে ২৩ অক্টোবর ১৯২৯। ২০০৬ এর ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার মিতসুবিশি পুরস্কার জাপান, আনন্দ পুরস্কার ইন্ডিয়া এবং আরো বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কার।