সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্য ও জ্বালানি পরিবহনে প্রয়োজন হয় বৃহদাকার জাহাজ। বাংলাদেশের সে ধরনের জাহাজ নেই। তাই আমদানি করা হচ্ছে বড় আকারের জাহাজ। আমদানির প্রক্রিয়ায় থাকা এসব জাহাজের প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টন থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টন পর্যন্ত। আমদানিকৃত এসব জাহাজ সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকার ভোগ্যপণ্য, বিশেষ করে চাল, গম, ডালসহ জ্বালানি তেল আমদানি করার কাজে ব্যবহৃত হবে। সরকারের পক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এসব জাহাজ চীন থেকে আমদানি করছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে চূড়ান্তভাবে ছয়টি জাহাজ আমদানি প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই ছয়টি জাহাজ ডিজেল, কয়লা এবং খাদ্যপণ্য পরিবহন কাজে ব্যবহৃত হবে। এর রয়েছে চারটি জাহাজের প্রতিটির ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ৮০ হাজার টন। এ চারটি জাহাজ (ডিজেল, কয়লা পরিবহন উপযোগী) মাদার প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার। প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার সিবিএম ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বাকি দুটি নতুন জাহাজ এলএনজি ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দেশীয়ভাবে দুটি কোম্পানি জাহাজ তৈরি করছে। আনন্দ শিপ ইয়ার্ড ও ওয়েস্টার্ন মেরিন নামে দুটি কোম্পানি উৎপাদিত জাহাজ নেদারল্যান্ড, মোজাম্বিক ও ফ্রান্সে রফতানি করছে। ১৯৯৯ সালে নেদারল্যান্ডে একটি হসপিটাল বোট রফতানির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে আনন্দ শিপইয়ার্ড। পরবর্তী সময়ে এ কোম্পানিটি ২০১৮ সাল পর্যন্ত কন্টেইনার, কোস্টাল ফেরি, ওয়াটার ট্যাক্সি, কার্গোসহ বিভিন্ন ধরনের ১১টি জাহাজ রফতানি করেছে। 

সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সম্প্রতি বড় আকারের জাহাজ উৎপাদন করছে। এসব দেশ এখন ছোট সাইজের লাইটার জাহাজ উৎপাদন করে না। এই সুযোগটি নিয়েছে বাংলাদেশের এ দুটি কোম্পানি। তাদের তৈরি করা জাহাজ আকারে ছোট। এসব কোম্পানির তৈরি করা জাহাজের ধারণক্ষমতা দুই হাজার ৮০০ টন থেকে তিন হাজার ৫০০ টন পর্যন্ত। এজন্য দেশীয় কোম্পানির তৈরি জাহাজ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাজে আসে না। তাই বড় সাইজের জাহাজ আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। সরকার সবচেয়ে ছোট যে জাহাজটি আমদানি করে তার ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ১০ হাজার টন। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনন্দ শিপ ইয়ার্ডের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহিল বারি বলেন, ‘আমরা ক্রমান্বয়ে বড় সাইজের জাহাজ উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছি। বেশ চাহিদাও রয়েছে। তবে ছোট সাইজের লাইটার জাহাজ উৎপাদন এবং রফতানির ক্ষেত্রে আমরা বেশ ভালো করছি।’

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) একটি সূত্র জানায়, বিএসসির জাহাজ অর্জন পরিকল্পনার মধ্যে বর্তমান জাহাজ বহরের প্রতিস্থাপন ছাড়াও একাধিক বিভিন্ন আকার ও ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ সংগ্রহের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত। অধিকন্তু দেশের মোট আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে সরকারি খাতে পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসায়িক চাহিদা এবং সরকারের সপ্তম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা, রূপকল্প,  ভিশন-২০২১ এবং ২০৪১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি)সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিএসসির জাহাজ কেনার প্রকল্প বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে দুটি নতুন জাহাজ কেনার পরিকল্পনা। প্রতিটির ধারণক্ষমতা থাকবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত। এ দুটি জাহাজ সরকারিভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং বিভিন্ন প্রকার কেমিক্যাল আমদানির কাজে ব্যবহার করা হবে। আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা আরও দুটি জাহাজের প্রতিটির ধারণক্ষমতা এক লাখ থেকে এক লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত। এ দুটি জাহাজই মাদার ভেসেল। এ ছাড়াও ১০টি নতুন ১০ থেকে ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ আমদানি করা হবে। এসব জাহাজ বিভিন্ন প্রকার ভোগ্য পণ্য আমদানির কাজে ব্যবহার করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন চারটি কন্টেইনার জাহাজও কেনা হবে। যার প্রতিটির ধারণক্ষমতা এক হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টন। এসব জাহাজ দেশীয় কোম্পানি থেকে কেনা হতে পারে বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।

সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্রপথে পণ্য ও বিশেষায়িত কার্গো পরিবহন ছাড়াও বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় টুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রমোদতরী পরিচালনা ও সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক অবস্থানে শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব। পাশাপাশি সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও যথাযথ পরিচালনার মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে বিলাসবহুল প্রমোদতরী কেনার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদ জানিয়েছেন, বিএসসিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতেই জাহাজ কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব জাহাজে সরকারের নিজস্ব প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি ভাড়ার কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে পরিবহন ব্যয় কমবে, অপরদিকে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সরকার চীন থেকে ছয়টি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শেষ করেছে। ইতোমধ্যেই চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) থেকে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য ছয়টি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরও ছয়টি জাহাজ সংগ্রহ করা হবে। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি চীন সফর করে এসেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি চীনের বেইজিংয়ে সিএমসি অফিস পরিদর্শন করেছেন। এ সময় চীন থেকে বিএসসির জন্য আরও ছয়টি জাহাজ সংগ্রহের বিষয়েও আলোচনা হয়।

প্রসঙ্গত, বিএসসিকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে এক হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে ছয়টি জাহাজ সংগ্রহের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চীন আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা, বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারের। এ পর্যন্ত পাঁচটি জাহাজ বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে– এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার সমৃদ্ধি, এমভি বাংলার অর্জন, এমভি বাংলার অগ্রযাত্রা ও এমভি বাংলার অগ্রদূত।

বাকি একটি জাহাজ ‘এমভি বাংলার অগ্রগতি’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রতিমন্ত্রী চীন গিয়েছিলেন। বিএসসির বহরে আরও ছয়টি জাহাজ সংগ্রহ করা হবে। এজন্য প্রাথমিকভাবে এর ব্যয় ধরা হয়েছে দুই দশমিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি একনেকে অনুমোদন পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক নৌপথে নিরাপদ ও দক্ষ শিপিং সেবা প্রদান এবং আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের যাবতীয় কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সমাধাকল্পে ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশ বলে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে ‘বাংলার দূত’ ও ১৯৭৩ সালে ‘বাংলার সম্পদ’ অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএসসি এ যাবৎ সর্বমোট ৩৮টি জাহাজ সংগ্রহ করে। পুরনো ও বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক বিবেচিত হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬টি জাহাজ বিক্রি ও অন্যত্র হস্তান্তর করার পর বর্তমানে বিএসসির বহরে মাত্র দুটি লাইটারেজ ট্যাংকার রয়েছে। বর্তমানে চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ছয়টি নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটটিতে।





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews