গাজায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বে জনমতের ক্ষেত্রে একটি তীব্র, দৃশ্যমান এবং অভূতপূর্ব পরিবর্তন স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গাজায় ২০ মাসের বেশি সময় ধরে চলা সামরিক অভিযান, যেটি বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার মতে যুদ্ধাপরাধ এবং নিপীড়নের উদাহরণ, তা পুরো পৃথিবীর চোখে ধরা পড়েছে। আর এই পরিবর্তনের ঢেউ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।

এক সময় যারা শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতো, তারা এখন ইসরাইলি রাষ্ট্র এবং এর সামরিক বাহিনীর প্রতি ঘোষিত বৈরিতা প্রকাশ করছে। ‘মৃত্যু হোক আইডিএফ’-এর মতো স্লোগান ব্রিটেনের গ্লাস্টনবারি কনসার্টের মঞ্চেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এটি কেবল একটি আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া নয়। বরং একটি গভীর রাজনৈতিক বার্তা। যাতে একটি উপনিবেশবাদবিরোধী অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছে।

ইসরাইল যদিও দাবি করে যে এসব স্লোগান পুরো ইসরাইলি জনগণকেই লক্ষ্যবস্তু করে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই স্লোগানগুলো তাদের দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই আঙুল তোলে, যাদের কার্যকলাপ আজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। অবশ্য ইসরাইল এই বিভাজন মেনে নিতে নারাজ।

যদিও অতীতে মিডিয়া এবং লবির মাধ্যমে ইসরাইল পশ্চিমা সমাজে নিজের ভাবমূর্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, এখন সোশ্যাল মিডিয়া সেই আধিপত্য ভেঙে দিয়েছে। লাখো স্বাধীন ব্যবহারকারী, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং সাংবাদিক ইসরাইলি আগ্রাসনের বিপরীতে ফিলিস্তিনের পাশে অবস্থান নিয়েছেন। এর ফলে মিডিয়া-নির্ভর রাষ্ট্র ইসরাইল গভীরভাবে ব্যতিব্যস্ত।

এই পরিবর্তনকে ধরে রাখতেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও হ্যারিস ইনস্টিটিউটের মতো গবেষণা সংস্থাগুলো নিয়মিত আমেরিকান জনমত পর্যবেক্ষণ করছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে চালানো জরিপে দেখা যায়, তখনো মার্কিনিদের ৮৪ শতাংশ ইসরাইলকে সমর্থন করছিল। কিন্তু তরুণদের মধ্যে এই হার ছিল ৫২ শতাংশ। যেখানে হামাসের প্রতি সমর্থন ছিল ৪৮ শতাংশ। সেই সংখ্যা এখন আরো এগিয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, হামাসের প্রতি মোট জনসমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ।

এই ধারা ইসরাইলের মধ্যে এক ভীতিকর অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। কারণ, তারা দেখতে পাচ্ছে যে পশ্চিমা বিশ্বে যে মিডিয়া ও বর্ণনার রাজত্ব তারা কয়েক দশক ধরে ধরে রেখেছিল, তা ভেঙে পড়ছে। জনমনে পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে মুসলিম বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানির সম্ভাব্য প্রার্থিতা।

এর জবাবে ইসরাইল আবার ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’র অভিযোগ তোলা শুরু করেছে। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বা ইসরাইলের সমালোচনাকে এই অভিযোগের চাদরে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব, ইউএনআরডব্লিউ বা সাংবাদিক পিয়ার্স মরগানের মতো ব্যক্তিরাও এই অভিযোগের শিকার হচ্ছেন।

জায়নবাদের সমালোচনাকে ইহুদি-বিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করার যে কৌশল নেয়া হয়েছে, তা ইসরাইলের একটি কৌশলগত ভুল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি একটি সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমগ্র ইসরাইলি সমাজের পরিচয়ে রূপান্তর করছে। আর ইসরাইল এমন একটি রাষ্ট্র, যার মালিক সেনাবাহিনী। রাষ্ট্র সেনাবাহিনীর কর্তা নয়।

পশ্চিমা সমাজ এই পুরনো পদ্ধতিতে ক্লান্ত। বারবার ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগে তারা উদাসীন হয়ে পড়ছে। ‘আইডিএফের মৃত্যু’ এখন একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে- একটি পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।

এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলি বিশ্লেষকরা বারবার সতর্ক সঙ্কেত দিচ্ছেন। পশ্চিমা সমাজের এই কৌশলগত বদল যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা কেবল জনমতের স্তরে থেমে থাকবে না। বরং নির্বাচনী ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই পরিবর্তনের সুযোগকে ফিলিস্তিনপন্থী এবং মানবাধিকারকর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইসরাইলের আতঙ্ক শুধু স্লোগান বা প্রতিবাদ নিয়ে নয়। বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিবেকের পুনর্জাগরণ নিয়ে। এই পরিবর্তন যদি গভীর হয় এবং স্থায়ী হয়, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক প্রভাব ফেলতে পারে।

সূত্র : আল জাজিরা



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews