সরকারের নির্বাহী আদেশে দুই বছর এক মাস ১৬ দিন পর কারাজীবন থেকে মুক্তিলাভ করে ‘হ্যাপি’ হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে এখনই নিবিড়ভাবে তাকে চিকিৎসা প্রদানের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছে বিএনপি। ফলে, আপাতত রাজনীতি নিয়ে কোনও শব্দও ব্যবহার করবেন না খালেদা জিয়া। তবে, নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়ে তাদেরকে করোনা থেকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি। বুধবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যা সাতটার পর রাজধানীর গুলশানে দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেরুনোর পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে এসব বিষয় জানা গেছে।
বিএনপির নীতি নির্ধারকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও তার নিরাপত্তাই দলের টপ প্রায়োরিটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একইসঙ্গে নেতারা খালেদা জিয়া নাই চাইলে সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকবেন।
গতকাল ২৪ মার্চ বিকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অনেকটাই আচমকাই সাংবাদিকদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে জানান, তারা বিএনপির চেয়ারপারসনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার সঙ্গে দিন পনেরো আগে খালেদা জিয়ার ভাই-বোন সাক্ষাৎ করে মুক্তির আবেদন জানিয়ে এসেছেন। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে স্বস্তির বিষয়টি জানানো হয়। তবে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে নেতাকর্মীদের কঠোরভাবে স্বাগত-জমায়েত থেকে বিরত থাকতে দলীয়ভাবে বলা হয়। কিন্তু, এই আবেদন বুধবার দুপুরের পর থেকে উপেক্ষিত হতে থাকে। আজ ঢাকা শহরে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পুলিশের লক্ষ্যণীয় টহলও ছিল। কিন্তু, তারপরেও শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, আশেপাশে ও রোগী-রোগীর আত্মীয় পরিচয়ে সহস্রাধিক নেতাকর্মী নেত্রীকে সামনে থেকে দেখতে মরিয়া হয়ে উঠে। বিকাল সোয়া চারটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় তাকে এনেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা বের করার ক্ষেত্রে হিমশিম খান দলীয় নেতা-কর্মী ও গণমাধ্যমের কর্মীরা এলোমেলো অবস্থানের কারণে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও নেতা-কর্মীদের কেউ তাদের জায়গা ছাড়েননি, পুলিশের কথা কানে তোলেননি। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেমালুম উপেক্ষা করেছেন তারা।
বিকাল চারটা ২০ মিনিটে বিএসএমএমইউ চত্বর থেকে মূল সড়কে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত তার গাড়িবহরের সামনে-পেছনে নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরবাইকের উপস্থিতি বাড়ে। তবে অন্য কারও গাড়িতে নয়, জিম্মাদার ছোটভাই শামীম ইস্কান্দর নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে গুলশানের ফিরোজায় নিয়ে গেছেন খালেদা জিয়াকে। বোন সেলিমা ইসলাম, সেলিমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, আরেক প্রয়াত ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দুসহ পরিবারের সদস্যরা ফুল দিয়ে বরণ করে নেন তাকে।
বরণের পর কী বললেন আপনার বোন--এমন প্রশ্ন করা হয় খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলামকে। বুধবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘তিনি তো খুব অসুস্থ। খুব একটা কথাবার্তা বলতে পারছেন না। আমরা সবাই, আমার ভাই, ভাইয়ের বৌ ও তার ছেলে সবাই তার সঙ্গে আছি এখানে।’
মুক্তি পেয়ে তার অভিব্যক্তি কেমন পেয়েছেন, এমন প্রশ্নে সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘তিনি হাসিমুখে বলেছেন যে খুশি। সো হ্যাপি। সবার খোঁজ নিচ্ছেন। আসলে হুইল চেয়ারে তিনি বসে আছেন। এখন কিছুদিন তিনি রেস্টে থাকবেন।’ তিনি এও জানান, মায়ের এই বিশেষ মুহূর্তে দেশে নেই তার বড় ছেলে তারেক রহমান। তাদের সঙ্গে খালেদা জিয়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে কথা বলবেন।’ কথা বলা অবস্থায়ই সেলিমা ইসলাম জানান, ওইসময় বিএনপির চেয়ারপারসনের সামগ্রিক খোঁজখবর জানতে চিকিৎসকদের একটি দল ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য এসেছেন বাসায়।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে সঙ্গে থেকে তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলীয় নেতারা গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে চলে গিয়েছিলেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে খালেদা জিয়ার বাসা ফিরোজায় আবারও প্রবেশ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জ্জা আব্বাস ও ড. আবদুল মঈন খান। তাদের সঙ্গে ডা. এ জেড জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল। স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য অবশ্য দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ছোটখাটো বৈঠকও সেরেছেন একটি। এরপর দলবেঁধে এসেছেন ফিরোজায়।
স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনা করা হচ্ছে। ডা. জাহিদ ইতোমধ্যে স্বাস্থের পরীক্ষা করানোর সরঞ্জামসহ হাজির হয়েছেন। আর দ্বিতীয়, করোনাঝুঁকির কারণে খালেদা জিয়া ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন এবং এই সময়ে তিনি কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না।
নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাইরে এসে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া অসুস্থ। এই অবস্থায়ও তিনি সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি নেতাকর্মীদের কোয়ারান্টাইনে থাকতে বলেছেন। তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ও মহামারিতে নেতাকর্মীদের সচেতন থাকতে ও ভালোভাবে চলতে বলেছেন তিনি। সবাইকে মহামারি থেকে বেঁচে চলাফেরা করতে বলেছেন।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে স্বল্পসময়ের সাক্ষাৎশেষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বিশেষভাবেই বলতে চাই, ভীষণভাবে স্বস্তিবোধ করছি এবং খুশিও। তিনি নিজের বাড়িতে অন্তত ফিরে এসেছেন। আমরা বিশ্বাস করি যে তার মানসিকভাবে উন্নতি লাভ করবেন এবং শারীরিকভাবেও। এখনই (সন্ধ্যা পৌনে সাতটা) তার পছন্দের চিকিৎসকরা বসে গেছেন আমরা আসার সময়। তারা দেখবেন, তার কী প্রয়োজন। সেগুলো দিয়ে তারা বেগম জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।’
মুক্তির পর খালেদা জিয়ার অভিব্যক্তি কেমন ছিল, জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘তিনি রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলবেন না। আজকেও রাজনীতি নিয়ে কিছু বলেননি। কোনও রকমের কোনও কারণে আমরা চাই না তিনি এখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলুন। কারণ, আমরা চাই তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর দেখা যাবে, রাজনীতি করার সময় তো পড়ে আছে এখনও, পালিয়ে যাচ্ছে না। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তাকে আমরা অনেকটা কোয়ারেন্টাইনে রাখতে বলেছি। আমরা নিজেরাও কম সাক্ষাৎ করবো। তিনি যদি চান, তাহলে যাবো, না হলে যাবো না।’ কেউই ওখানে যাবে না, বলে জানান ব্যারিস্টার মওদুদ।
কারণ ব্যাখ্যা করে মওদুদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস অনেক বড় সমস্যা। এটা থেকে তাকেসহ সারা জাতিকে মুক্ত রাখতে হবে এখন। সে পরিকল্পনা চলবে এখন। আমাদের টপ প্রায়োরিটি হচ্ছে তার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা।’
খালেদা জিয়ার স্বাস্থের সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে কথা হয় তার মেডিক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিলন মিয়া সরকারের সঙ্গে। বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘আমি আজকে সরাসরি তার কাছে যাইনি। আজকে আমি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে অ্যাডভাইস লিখে দিয়ে এসেছি। বোর্ডের একজনকে ছাড়া সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেছি। একজন বক্ষব্যাধি ও বাতের চিকিৎসক তাকে দেখেছেন আজ। আমি শনিবার দেখেছিলাম তাকে। সবগুলো আগের মেডিসিন ও সর্বশেষ অ্যাডভান্স চিকিৎসার বিষয়টি লিখেছি। তার ব্লাড সুগার ৯.৪। সবাই হাসপাতালে থাকলেও ভিড়ের কারণে সবাই যাইনি। তার জয়েন্টের সমস্যাটি আছে। অ্যাডভান্স চিকিৎসার অ্যাডভাইস লিখেছি, এটার জন্য তাকে হাসপাতালেই ভর্তি হতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘খালেদা জিয়া মুক্ত হয়েছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তিনি রাজনীতি করবেন সুস্থ হওয়ার পর।’
তবে, দল পরিচালনায় কোনও পরিবর্তন আসতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রভাবশালী এ নেতা বলেন, ‘প্রয়োজন নেই। তিনি টেকনিক্যালি তো থাকবেন। তারেক রহমান দল ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। সেক্ষেত্রে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এটা বুঝবে, যে এর পেছনে বেগম জিয়ার এখন পরামর্শ আছে এবং তারা এ কারণে স্বস্তিতে থাকবে।’
তিনি জানান, আপাতত দল পরিচালনায় কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি আমাদের দলের জন্য, নেতাকর্মীদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ। তার বেরুনোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা উদ্দীপনা পাবে। যে পরিস্থিতি আছে, তাতে চাঞ্চল্য ফিরে আসবে। আর দল পরিচালনায় যেহেতু ওপেনলি ম্যাডাম এখন কিছু করবেন না, সে কারণে আমাদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই নেতৃত্ব দেবেন।’