‘নতুন বন্দোবস্ত’- শব্দ দুটি শুনতে বেশ ভালোই লাগে। মনে হয় সমাজ পরিবর্তনের আভাস মিলছে। বাস্তবে, কতটুকু সেটি সম্ভব, সেটাই বড় প্রশ্ন। তবে গণঅভ‍্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে যেমনটি প্রত‍্যাশা করা হয়েছিল, বাস্তবে এখনো সেটি প্রতিফলিত হয়নি। এখনো সবাই পুরনো ধ‍্যান ধারণার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পুরনো বন্দোবস্তে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। নতুন বন্দোবস্ত নিয়ে কথা বললেও বাস্তবে সেটির দেখা মিলছে না। 

সামনে নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়েই কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। যদি নির্বাচন ব‍্যবস্থা নিয়ে বলি, তাহলে নিউইয়র্ক শহর আমাদের জন‍্য হতে পারে এক বড় উদাহরণ। মাত্র শেষ হলো নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্রেটিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে বাছাই পর্ব। এই পর্বে অনেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ত্রিশের কোটার এক যুবক জোহরান মামদানিকে ভোট দিয়েছে মার্কিনিরা। কেউ তাকে ভালোভাবে চেনেও না, তাহলে কিভাবে এটি সম্ভব হলো।

এখানে চমৎকার একটি বিষয় দেখা গেল। আমেরিকায় রাজনৈতিক দলগুলো কখনো জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করায় না। প্রার্থীরা নিজেরাই মুখোমুখি দাঁড়ায়। জনগণ সেটি দেখে এবং উপভোগ করে, আর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হন- তবে সেটা টেলিভিশনের বিতর্কে, যুক্তির মঞ্চে। সেখানে তারা জনগণকে কখনো পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় না। বরং ভোটারদের জন্য খোলা থাকে তথ্যের দরজা। কে কী বলছে, কে কীভাবে শহরের উন্নয়ন করবে- তা সরাসরি জানতে পারে জনগণ। টেলিভিশনের পর্দায় থাকে চোখ। আট বা দশজন প্রার্থী মুখোমুখি বিতর্ক করছে। জনগণ রাস্তায় প্রজেক্টরে বা ঘরে বসে দেখছে নেতাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে, কে তাদের জন‍্য কাজ করবে। কাকে তাদের দরকার। কোনো হুমকি নেই, ভয় নেই, বাধা নেই। যার প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি হয়, সে-ই জয়ী হয়।

এখানে নির্বাচন মানে ভয় বা প্রাণহানির শঙ্কা নয়, বরং একটি উৎসব, গণতন্ত্রের চর্চা। আর আমাদের দেশে নির্বাচন মানে অগণিত লাশ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, একে অন‍্যর ওপর হামলা। সেই পুরনো পদ্ধতি ঘুরেফিরে এখনো বলবৎ আছে বলেই দেখতে পাচ্ছি। 

সম্প্রতি ইশরাক হোসেন মেয়র ঘোষণার জন‍্য অবরোধ করেছেন। সিটি হল দখল করছেন। অর্থাৎ পুরনো বন্দোবস্তেই আমরা ঘুরেফিরে আছি। আর নতুন বন্দোবস্ত করতে হলে ইশরাক হোসেন প্রথমে নিজ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিদের মাঝে ভোটে দাঁড়াক। সেখানে দলের কর্মীরা ভোটের মাধ‍্যমে যোগ‍্য একজন প্রার্থীকে মেয়র হিসেবে বাছাই করতে পারে। তখন এটি হতে পারে নতুন বন্দোবস্ত। প্রত্যেকেই জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে নিজেরাই টেলিভিশন বিতর্কে মুখোমুখি হবে। কে কতটা শহরের জন‍্য ভালো করবে, তখন জনগণ বিতর্ক দেখেই নেতা নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে। মারামারির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি হবে। এটিই বাংলাদেশের জন‍্য হবে নতুন বন্দোবস্ত। 

নিউইয়র্কে এর মধ্যে শেষ হলো ডেমোক্রেট দলের মেয়র নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই। সর্বত্র ঘুরে নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, কারও মধ্য এ নিয়ে নেই কোনো উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। কোথাও নেই পোস্টার-ব্যানারের ঝলক, নেই কোনো হট্টগোল বা অশান্তি। এই দেশে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে- সেটি বোঝার জন্য হয়তো খবরে চোখ রাখতে হবে, নাহলে অনেকের মনেও থাকে না। রাস্তায় নেই মিছিল, নেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। কেউ কারও সভায় হামলা করছে না, প্রতিপক্ষের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে না, প্রাণহানি তো দূরের কথা- একটা ছোটখাটো ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও শোনা যায় না। 

অথচ বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই যেন যুদ্ধের ময়দান। লাশ পড়ে রাস্তায়, গুলি চলে জনসভায়, ভোট কেন্দ্র রক্তে ভেসে যায়। ঘরে-বাইরে বাড়িতে হামলা, কখনো কখনো প্রতিপক্ষ বাদ দিয়ে নিজেরা নিজেদেরকেই রক্তাক্ত করছে। অথচ আমেরিকায় গুরুত্বপূর্ণ এমন নির্বাচনে পক্ষ-বিপক্ষে সামান্য বিতর্ক করতেও দেখা যায় না। কেউ কথা বলতে চাইলেও অন‍্যজন ‘সরি’ বলে সরে যায়। এই দেশে জনগণ কখনোই জনগণের মুখোমুখি হয় না। রাজনীতিবিদরাই একে অপরের মুখোমুখি হয়। জনগণ তাদের কর্ম নিয়েই ব‍্যস্ত। শুধু ভোটটি প্রয়োগ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। 

আমাদের বাংলাদেশ কি এই দৃশ্যপট থেকে কিছু শিখতে পারে না? বাংলাদেশে আজ যদি এমন একটি পদ্ধতি চালু করা যেত, যেখানে প্রতিপক্ষ নয়, যুক্তি-তথ্যের ওপর নির্ভর করে জনপ্রিয়তা তৈরি হতো, তাহলে সেটিই হতো সত্যিকারের ‘নতুন বন্দোবস্ত’। যেখানে নির্বাচনী মাঠ হবে যুক্তির, টেলিভিশনের, মতবিনিময়ের। যেখানে জনতার হাতে থাকবে সিদ্ধান্ত, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আদায়ের পথে থাকবে না কোনো মৃত্যু, কোনো রক্তপাত। 

ইশরাক হোসেন মেয়র নির্বাচন করতে চায়, সেখানে একই দলের আরও পাঁচজন নির্বাচন করুক। তারা এই শহরকে কী দেবে সেটি টেলিভিশনের পর্দায় জনগণের সামনে তুলে ধরুক। তাহলেই সেখান থেকে যোগ্যতম ব‍্যক্তি বেরিয়ে আসবে। দেখা যাবে নতুন প্রজন্মের জোহরান মামদানির মতো প্রার্থী বেরিয়ে আসছে। যারা আগামীদিনে দুর্নীতি না করে স্বপ্নের একটি শহর গড়ে তুলবে। দায়বদ্ধতা নিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যাবে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে আমরা এমন চিত্রই দেখতে পাই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, নির্বাচন মানে প্রতিপক্ষ ধ্বংস নয়, বরং বিকল্প চিন্তার প্রতিযোগিতা। যে দিন আমাদের নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ, তথ্যভিত্তিক এবং অংশগ্রহণমূলক- সেই দিনই আমরা বলতে পারব, সত্যিকার অর্থে নতুন বন্দোবস্ত এসেছে আমাদের দেশে।

আজকের দিনে যখন জোর করে পদ দখলের মিছিল শুরু হয়। তখন মনে হয় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। নির্বাচন মানেই আমাদের দেশে যেন মিছিল-মিটিং, পোস্টার, গুজব, হুমকি কিংবা দলীয় চাটুকারদের প্রশংসাবাণী। অথচ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে নির্বাচন শুরুই হয় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যুক্তি দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মধ্য দিয়ে।

ভাবুন তো! যদি কোনো মেয়রপ্রার্থী ভোটের আগেই পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে টেলিভিশনের লাইভ বিতর্কে মুখোমুখি হতেন? যদি জনগণের সামনে তারা নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরতেন, বিরোধীরা কঠিন প্রশ্ন করতেন, আর সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নিতেন- আসলেই যোগ্য ব‍্যক্তিটি কে? বিষয়টি কেমন হতো।

এটাই তো হয়ে থাকে নিউইয়র্কে, লন্ডনে কিংবা অন্য আধুনিক শহরগুলোতে। নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য জোহরান মামদানি, তাকে আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে একটি থানার নির্বাচিত লোক। পুরো শহরের মানুষ তাকে ভালোভাবে চেনেও না। সে-ই ঘোষণা দিল আমি মেয়র ইলেকশন করব। দল বলল, তোমার কি যোগ্যতা আছে যে তুমি একটি শহরের মেয়র হতে চাও। অনেক অভিজ্ঞ মানুষজন যেখানে আছে, যাদেরকে সবাই চেনে, সেখানে তো তুমি জিরো। ঠিক আছে আসো, তুমি যোগ্যতার প্রমাণ দাও। 

সব প্রার্থীর মতো তিনিও প্রচারণায় নামলেন। ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করলেন। মানুষ তাকে জাজ করা শুরু করল। তারপর এনবিসি টেলিভিশনে ৮ জন প্রতিযোগির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। পোল শুরু হলো। সবার পেছনে থেকে প্রথম দফায় বিতর্কে অনেক এগিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় দফা বিতর্কে সবাইকে ছাড়িয়ে এন্ড্রু কওমোর মতো অভিজ্ঞ ঝানু রাজনীতিবিদকে ধরাশায়ী করে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করে ফেললেন। আর দীর্ঘ এই প্রক্রিয়াতে ছিল না কোনো হাঙ্গামা, মারামারি বা দলাদলির মতো ঘটনা। এখানে দল, বংশ বা পেশির জোর নয়, বরং যুক্তির শক্তিই হলো মূল হাতিয়ার। 

শহরকে কে কোন চোখে দেখে, কি করতে চায়, সে কতটুকু করতে পারবে। তার কণ্ঠস্বর পরিমাপ করেই মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। আগামী দিনে মেয়র হয়ে শহর চালানোর জন‍্য সে অধিক যোগ্য। 

আমরা চাই, আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন একটি রেওয়াজ তৈরি হোক। পুরনো চিন্তা, পুরনো ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে, মিছিল-মিটিং, শোডাউন, দলে দলে রাস্তায় নামা- এসব পুরনো কায়দা বাদ দিয়ে আমাদের নেতারা নতুন পথে হাঁটুক। আমাদের চাওয়া, যারা আমাদের দেশ বা শহরকে নেতৃত্ব দিতে চান, তারা টেলিভিশনের পর্দায় একে অপরের মুখোমুখি হোক। তুলে ধরুক নিজেদের চিন্তা, চোখে চোখ রেখে বিতর্ক করুক, যুক্তি-তর্কের লড়াই করুক। এই শহরের জন‍্য তারা কী করতে চায় খোলাখুলি বলুক। শুধু শুধু ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা হাজির করুক। জনগণ দেখুক, তারপর সিদ্ধান্ত নিক। 

আমাদের দেশে যখন নির্বাচন শুরু হয়, তখন দেখি নেতা-নেত্রীদের পোস্টার-ব‍্যানারে সব ছেয়ে যায়। বড় বড় মিছিল হয়, স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ জানেই না কে তাদের জন‍্য কী করবে? কার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত। কে শুধু মুখে মুখে কথা বলে, আশ্বাস বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে, আর কে সত্যিকারের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?

আমরা চাই আমাদের রাজনীতিতে নতুন এই বন্দোবস্ত আসুক। মিডিয়া বা টেলিভিশন স্টুডিও হোক প্রতিযোগিতার মাঠ। হানাহানি, হাঙ্গামা, মারামারির বদলে ক্যামেরার সামনে বসে জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিন, প্রতিপক্ষের যুক্তির জবাব দিন। এই বন্দোবস্তের মাধ্যমেই হতে পারে রাজনীতির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। আমাদের ভোটটা শুধু আবেগে নয়, হোক বিবেচনায়।

শহর নিয়ে যে কোনো সিদ্ধান্তের আগে শহরবাসী যেন বুঝতে পারে কার হাতে শহরটি নিরাপদ। আর এটাই হতে পারে রাজনীতির সবচেয়ে জরুরি সংস্কার। এই সংস্কৃতি চালু করতে পারলে বদলে যাবে রাজনীতির ধারা। যারা দেশকে, শহরকে নেতৃত্ব দিতে চান, তাদের বুঝতে হবে- সময় বদলেছে, রাজনীতির ধরনও বদলাতে হবে। 

তাই বলব, যারা দেশ জাতির নেতৃত্ব দিতে চান, তাদের নতুন পরীক্ষার মঞ্চ হোক টেলিভিশনের পর্দা। এটিই হবে নতুন রাজনীতির ‘নতুন বন্দোবস্ত’।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews