সমকালীন প্রসঙ্গ

স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠনে গোড়ায় পানি দিতে হবে



দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ। এতে আমাদের অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের ছবি যতটা ফুটে ওঠে, তার চেয়ে বেশি উদোম হয়ে পড়ে মন ও মগজের দীনতা। শুধু মনুষ্যজাতি কেন, যে কোনো প্রাণীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো তার স্বাস্থ্য। অথচ এমন একটি জরুরি বিষয়ে আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিই না। পুরো খাতটি ভয়াবহ দুর্নীতিতে বিপন্ন। তাছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে নানা সিন্ডিকেট ও কারসাজি। স্বাধীনতার পর থেকে অন্যান্য খাতের মতোই স্বাস্থ্য খাতটিও বিভিন্নভাবে গুটি কয়েক মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংস্কারের নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই  মধ্যে সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে ১১টি কমিশন, যার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন একটি। গত সোমবার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হাতে ৩২২ পৃষ্ঠার স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি পেশ করেছে। 

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে প্রশাসনিক পুনর্গঠন এবং নীতিগত সিদ্ধান্তের বহু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। যেমন– স্বাস্থ্যবিষয়ক আলাদা কমিশন গঠন, পেশাজীবীদের উন্নতির লক্ষ্যে ভেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও পদোন্নতি, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে ওষুধের ৯৫ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সংস্কার প্রস্তাবে কাঁচামালগুলো দেশীয় ব্যবস্থাপনায় বাজারজাতকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

স্বাস্থ্যসেবা যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য মৌলিক বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পুরো খাতটি নাজুক পড়ে আছে। একদিকে স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবনতি ঘটেছে, বিপরীতে ব্যক্তিখাতে বড় বড় হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। পুরো প্রক্রিয়ায় গুটি কয়েক মানুষের হাত রয়েছে, যারা স্বাস্থ্য খাতের পুরোনো বন্দোবস্তটি ব্যক্তি পর্যায়ে কুক্ষিগত করেছেন। এতে সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। 

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের গোড়ার সমস্যা হাসপাতালের চারপাশে দালাল কিংবা ডাক্তারদের পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা নয়। বরং আমাদের খুঁজতে হবে পুরো প্রক্রিয়ার মূল জায়গা, যেখান থেকে সমস্যাগুলো শাখা-প্রশাখায় বিস্তারলাভ করেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাব দিতে গিয়ে কিংবা সমাধানের পথে হাঁটতে গিয়ে মূল জায়গায় কাজ করি না। অথচ স্বাস্থ্য খাতের এই দুরবস্থার প্রধান কারণ হলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে দেওয়া এবং সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরির বন্দোবস্ত করা।

অনাস্থা তৈরি বন্দোবস্তের মানে হলো, জনগণ ধরেই নিয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে যথাযথ সেবা দেওয়া হয় না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কিংবা জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও গেলে প্রথম দর্শনেই একটি নেতিবাচক মনোভাব জন্ম নেয়। এর পুরো দায় সরকার তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার। সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি এসব হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির প্রথম ও শেষ আশ্রয় ছিল সরকারি হাসপাতাল, তারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের এই মনোভাবের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতকে নিরঙ্কুশভাবে ছেড়ে দেওয়া এবং সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনার জঞ্জাল বহাল রাখা।

মূলত স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠন শুধু স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করছে না। রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার না হলে স্বাস্থ্য খাত দাঁড়াবে না। তার জন্য বিদ্যমান গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে জিম্মি থাকা অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট তৎপরতা সেই সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। চিকিৎসা খাতে গুটি কয়েক একচেটিয়া ব্যবসায়ীর প্রভাব বা সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে গেলে তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ রাষ্ট্রীয়করণ করা জরুরি। তার ওপর নির্ভর করছে প্রশাসনিক সংস্কার কতটা শক্তিশালী হবে।

মানবজীবনে স্বাস্থ্য এতটাই জরুরি যে, যেখানে আমরা সর্বস্বান্ত হওয়ার পরেও টাকা ব্যয় করতে দ্বিধা করি না। কারণ প্রাণীর মাত্রই জীবনের প্রতি মায়া রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটিই হয়ে পড়েছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সমাজে অর্থ সরবরাহের ভারসাম্য না থাকলে পুরো ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সে রকম এক অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খল চক্রে পতিত হয়েছি, যেখানে গুটি কয়েকের হাতে বেশির ভাগ অর্থ কুক্ষিগত রয়েছে। এতে সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। এ কারণে শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, দেশের প্রতিটি খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আশা করি, সরকার স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠনে আগায় পানি দেওয়ার পরিবর্তে গোড়ায় পানি দেওয়ার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করবে। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল 

iftekarulbd@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews