কোভিড-১৯ লকডাউন বিশ্বজুড়ে বিচারব্যবস্থাকে তীব্র চাপে ফেলে দেয়। বাংলাদেশে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০২০ সালের ২৯ মার্চ থেকে দেশের সব আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে জমে থাকা মামলার বিশাল জট লকডাউনের পর আরো বাড়তে থাকে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আদালতও দ্রুত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরুতে ‘মাইক্রোসফট মিটিংস’ ব্যবহার করা হলেও পরবর্তী সময়ে ‘জুম’ প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর করা হয়, যা ব্যবহারবান্ধব হলেও নিরাপত্তার দিক থেকে ছিল কিছুটা দুর্বল।

ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনা সহজতর করতে ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন-২০২০’ প্রণয়ন করা হয়। এ আইন শুধু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি; বরং একটি ‘ ডিমিং ক্লজ’ (কল্পনা ধারা) যোগ করে ভার্চুয়াল উপস্থিতিকে শারীরিক উপস্থিতির সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটির উল্লেখযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে আগাম জামিনসংক্রান্ত মামলায়, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগের সামনে আত্মসমর্পণ করতে হয়। সেই সাথে বিচারকের সামনে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হয়।

২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আদালতের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কোভিড-১৯ বিচারিক কার্যক্রমের ওপর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। লকডাউনের সময় মামলা দায়েরের সুযোগ সীমিত থাকায় আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। যদিও ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের (রিমিটেশন অ্যাক্ট ১৯০৮) ধারা ৫ অনুসারে যথাযথ কারণ উপস্থাপন করতে পারলে বিলম্ব ক্ষমার সুযোগ রয়েছে, তথাপি অনেক ক্ষেত্রে যেমন- ১৯৮০ সালের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইনের (অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৮০) আওতায় দায়ের করা আবেদনের ক্ষেত্রে আদালতের কাছে এ বিলম্ব মওকুফের বিধান প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে বহু অভিযোগকারী মামলা দায়ের করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া আরো অনেকের অভিযোগ আদালতে উপস্থাপন করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় ২০২০ সালের ৬ আগস্ট এক অন্তর্বর্তী আদেশের মাধ্যমে আপিল বিভাগ একটি নির্দেশ প্রদান করেন, যেখানে বলা হয়- ‘২৬ মার্চ ২০২০ তারিখ বা তার পরে যেসব আবেদন/পিটিশন/মামলা/আপিল/রিভিশন/ অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রম- কোনো দেওয়ানি, ফৌজদারি বা প্রশাসনিক মামলা, সাধারণ বা বিশেষ আইনের আওতায় দায়েরের সময়সীমা শেষ হয়েছে, সেগুলোর সময়সীমা ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হলো।’ আদেশটি সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ প্রদানের ক্ষমতার ভিত্তিতে দেয়া হয়।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে লকডাউন আবার কার্যকর হলে আপিল বিভাগ ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট সিভিল পিটিশন নং ২১৫১/২০২০-এর মামলায় আরেকটি আদেশ প্রদান করেন, যেখানে ৫ এপ্রিল ২০২১ বা তার পরে যেসব বিচারিক কার্যক্রমের মেয়াদসীমা শেষ হয়েছে, সেগুলোর সময়সীমা ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এসব আদেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ২৩ মার্চ ২০২০ স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়ের করা রিট পিটিশন (সিভিল) নং-৩/২০২০-এ মামলায় প্রদত্ত অনুরূপ আদেশের উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়। সময়সীমা বৃদ্ধির এসব আদেশ নিঃসন্দেহে বিচারিক আইন প্রণয়নের একটি হিতকর দৃষ্টান্ত। তবে এতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা বেশ কিছু আইনি নীতিমালার লঙ্ঘন ঘটেছে।

প্রথমত, আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ করার ক্ষমতাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে। এ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা শুধু ‘আপিল বিভাগের কাছে বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য’ প্রযোজ্য। ফলে আপিল বিভাগ সেসব মামলা বা কার্যক্রমের সময়সীমা বাড়ানোর এখতিয়ার রাখে না, যা তার কাছে বিচারাধীন নেই বা এখনো শুরুই হয়নি। ‘আপিল বিভাগে বিচারাধীন হোক বা না হোক’ এমন বিষয় নিয়ে একটি সাধারণ আদেশের মাধ্যমে সব বিচারিক কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলা সংবিধান অনুযায়ী ওই বিভাগের এখতিয়ার অতিক্রম করার শামিল। তা ছাড়াও ১০৪ নং অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ করার ক্ষমতা আপিল বিভাগকে নতুন কোনো এখতিয়ার দেয় না; বরং যেখানে আপিল বিভাগের এখতিয়ার আগে থেকে বিদ্যমান, সেখানে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। বাংলাদেশের কোনো আদালত, এমনকি আপিল বিভাগও, বিশেষ আইনে নির্ধারিত সময়সীমা বাড়ানোর এখতিয়ার রাখেন না। অথচ ঠিক এ কাজই করা হয়েছে ফজলুল হক বনাম গ্রামীণফোন লিমিটেড মামলায়। এখানে লক্ষণীয়, আপিল বিভাগ নিজেও অবগত ছিলেন যে, আইনের বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালের এমন ক্ষমতা নেই। আদালত নিজে স্বীকার করেছেন ‘বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বিশেষ আইনে নির্ধারিত সময়সীমা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে না।’ তবু ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ আদালত বিদ্যমান আইনের সূ²তা উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ কোনো নতুন আইনগত নীতি গঠন করেননি বা বিচারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি; বরং একটি জরুরি পরিস্থিতিতে এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা আইনগতভাবে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগের আদেশ সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত- ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন করেছে। যেখানে মামলার সময়সীমা সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে, সেখানে আপিল বিভাগের সেই সময়সীমা পরিবর্তন করার কোনো এখতিয়ার নেই- যতক্ষণ না সংসদ কর্তৃক সেই ক্ষমতা দেয়া হয়, (যেমন- ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ধারা ৫)। কিন্তু আপিল বিভাগ তার রায়ের মাধ্যমে একাধিক বিশেষ আইনে সংসদ কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমা পরিবর্তন ও বৃদ্ধি করেছেন, যদিও সংসদ এ ধরনের কোনো ক্ষমতা তাকে দেয়নি। এটি সংসদের এখতিয়ার সরাসরি হরণ করার শামিল। ১০৪ নং অনুচ্ছেদকে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনকে সংশোধনের ক্ষমতার উৎস হিসেবে দেখা উচিত নয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো- আপিল বিভাগ নিজে জানতেন যে, নিজে আইনসভার ক্ষমতা হরণ করছেন। এটি স্পষ্ট হয় যখন আদালত পর্যবেক্ষণ দেন- ‘আইন প্রণেতারা এমন দুর্যোগপূর্ণ ঈশ্বরপ্রদত্ত পরিস্থিতির পূর্বানুমান করতে পারেননি এবং করতে পারেন না। আমাদের সময়সীমাসংক্রান্ত আইন এ ধরনের অনিশ্চয়তা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত নয়।’ এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, আপিল বিভাগ আইন প্রণয়ন করেছেন, কারণ তার মতে আমাদের আইনসভা দূরদৃষ্টির অভাবে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তৃতীয়ত, সম্ভবত আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো- ফজলুল হক সরদার বনাম গ্রামীণফোন লিমিটেড মামলার রায়ে কোনো পূর্ববর্তী বিচারিক দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে আইনগত যুক্তি বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এ রায়ে শুধু ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের ওপর নির্ভর করা হয়েছে, যেটিতেও কোনো সুনির্দষ্ট আইনি বিশ্লেষণ ও অনুসরণীয় নজির পাওয়া যায় না। অতীতে যখন আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ প্রদানের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, তখন তা সুপ্রতিষ্ঠিত ন্যায়বিচারমূলক নীতির ভিত্তিতে পক্ষগুলোকে প্রতিকার প্রদান করতে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ কোনো পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করার বা তার অবস্থান সমর্থন করার মতো কোনো বিচারিক ভিত্তি নির্ধারণের চেষ্টা করেননি। এটি বিচারিক দায়িত্ববোধের একটি গুরুতর ব্যত্যয়, যা আদালতের সিদ্ধান্তকে আইনগতভাবে দুর্বল করে তোলে এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তাহলে সঠিক পন্থা কী হওয়া উচিত ছিল? উপরে আলোচিত হয়েছে, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত আইনগত গবেষণা করা হয়নি। উপরন্তু আদেশটি আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার আরেকটি দৃষ্টান্ত; যা অনেক সময় যথাযথ যুক্তি ও বিচারিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, স্পেন ও ইতালি কিভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করেছে, সে বিষয়ে তথ্য আদালতকে সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে এসব দেশের পদ্ধতির কোনো বিশ্লেষণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাজ্য নির্ধারিত সময়সীমা বৃদ্ধি করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। অন্টারিও প্রদেশও লকডাউনের সময় এ নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ হওয়ার বিষয়টি মোকাবেলায় আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশেও এ পন্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। বাংলাদেশে এর একটি পূর্ববর্তী দৃষ্টান্তও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক দাবি ও আইনি অধিকার সময়সীমা অতিক্রম করে নিষ্পত্তিযোগ্য হয়ে পড়েছিল। ফলে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ (লিগ্যাল প্রসিডিংস) অর্ডার, ১৯৭২ (প্রেসিডেন্ট’স অর্ডার নং. ১২ অব ১৯৭২) জারি করা হয়, যাতে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১ মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত সময়সীমাকে সব আইনি কার্যক্রমের সময়সীমা গণনার বাইরে রাখা হয়। দুঃখজনকভাবে এ গুরুত্বপূর্ণ আইনটি না বার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে, না আপিল বিভাগ তা বিবেচনা করেছেন। যদি দৃষ্টান্তটি আপিল বিভাগের দ্বারা বিবেচনা করা হতো, তাহলে হয়তো আদালত ভিন্ন একটি পথ গ্রহণ করতেন। আপিল বিভাগ আইনসভাকে নির্দেশনা দিতে পারতেন এভাবে যে, এ পরিস্থিতিতে একটি জরুরি আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সেটি হতো আইনগতভাবে সঠিক, সংবিধানসম্মত ও বিচারিক ভারসাম্য রক্ষার উপযোগী পন্থা।

আপিল বিভাগ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আদালত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। আদালতের বৈধতা অনেকাংশে বিচারিক দৃষ্টান্তের ওপর নির্ভর করে। একই সাথে বিচারিক দৃষ্টান্ত সমাজে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম নয়। আফসোসের বিষয়, ফজলুল হক বনাম গ্রামীণফোনের রায়টি উপকারী হলেও আদালত নিজে যেন একটি নতুন আইন তৈরি করে ফেলেছেন। যদি এ রায়কে শুধু তার প্রেক্ষাপটভিত্তিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা হয়, তা হলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে; যা বিচারব্যবস্থার কাঠামো ও সংবিধানিক ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews