অনেকেরই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে পডকাস্ট, অডিওবুক ও অন্যান্য অনলাইন কনটেন্ট দ্রুত গতিতে শোনার বা দীর্ঘ সময়ের ভিডিও কিছুটা করে সময় এগিয়ে নিয়ে দেখার। তরুণদের মধ্যে এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি, যাকে প্রচলিত কথায় বলে ভিডিও ‘টেনে দেখা’।

ক্যালিফোর্নিয়ার শিক্ষার্থীদের ওপর করা এক জরিপে উঠে এসেছে, নিজেদের অনলাইন লেকচারের প্লেব্যাক স্পিড বা গতি পরিবর্তন করেন ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, এ বিষয়টি বর্তমানে কতটা সাধারণ হয়ে উঠেছে তা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরেও প্রকাশ পাচ্ছে।

কোনো ভিডিও টেনে টেনে দেখার কিছু সুবিধা সম্পর্কে চিন্তা করা মানুষের জন্য সহজ। যেমন– ভিডিও বা অডিও দ্রুত চালালে কম সময়ে বেশি কিছু দেখতে বা শুনতে পারা যায়। আবার একই ভিডিও বা অডিও এভাবে টেনে টেনে কয়েকবার শুনেও ভালো করে বোঝা সহজ। এতে সময় বাঁচে আর অনেক তথ্য একসঙ্গে মেলে।

বিষয়টি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। কারণ, এতে জ্ঞান বুঝে নিতে, অনুশীলন পরীক্ষার জন্য ও অন্যান্য কাজের জন্য সময় বাঁচাতে পারেন শিক্ষার্থীরা। দ্রুত দেখে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ বলে মন অন্যদিকে হারানোর সম্ভাবনা কমে যায়।

এগুলো তো হচ্ছে টেনে টেনে ভিডিও দেখার সুবিধা। কিন্তু এর কি কোনও অসুবিধা নেই? ‘কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন’-এর ‘কগনিটিভ সায়েন্স’ বিভাগের একজন রিডার বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলছেন, আসলে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে।

কোনো ব্যক্তির তথ্য শোনার পরিস্থিতিকে গবেষকরা স্মৃতির তিনটি ধাপ হিসেবে আলাদা করেছেন। যেমন– তথ্য গ্রহণ বা এনকোডিং, তথ্য সংরক্ষণ ও পরে তা আবার স্মরণ করা। তথ্য গ্রহণের সময় মস্তিষ্কের কিছুটা সময় লাগে। কারণ এ সময়ে মস্তিষ্ককে সেই তথ্য ধরে ও এর অর্থ খুঁজে নেয়। এরপর সেই তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয় এবং পরে প্রয়োজন পড়লে তা আবার স্মরণ করে মস্তিষ্ক।

মানুষ সাধারণভাবে প্রতি মিনিটে প্রায় ১৫০টি শব্দ বলেন। এই হার দ্বিগুণ করে তিনশ ও তিনগুণ করে সাড়ে চারশ শব্দেও বলা যায়। তবে তা বোঝার মতো সক্ষমতা মানুষের নেই। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা যে স্মৃতি জমাই সেগুলোর মান ও স্থায়িত্ব কেমন হয়।

গবেষকরা বলছেন, যে কোনও নতুন তথ্য প্রথমে মানুষের মস্তিষ্কের অস্থায়ী এক মেমোরি সিস্টেমে জমা হয়, যাকে বলে ‘ওয়ার্কিং মেমোরি’। এটি তথ্যকে ভাগ করে সেটিকে হেরফের, সংযুক্ত ও বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। যাতে তা মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি মেমোরিতে পাঠানোর উপযোগী হয়ে ওঠে। তবে ‘ওয়ার্কিং মেমোরি’র ধারণক্ষমতাও সীমিত। মস্তিষ্কের এ অংশে খুব বেশি তথ্য খুব দ্রুত সময়ে এলে তা এর ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়। তখন মানসিক চাপ তৈরি হয় ও কিছু তথ্য হারিয়েও যেতে পারে।

দ্রুত দেখা ও তথ্য মনে রাখা

গবেষকরা দেখতে চেয়েছেন, মানুষ কত গতিতে ভিডিও দেখলে তা ভালোভাবে শিখতে পারেন। এজন্য ‘মেটা-অ্যানালাইসিস’ বা বিভিন্ন গবেষণার সারসংক্ষেপমূলক বিশ্লেষণে ২৪টি গবেষণাকে বিশ্লেষণ করেছেন তারা, যেগুলো তৈরি হয়েছে মূলত লেকচার ভিডিও দেখে শেখার ওপর ভিত্তি করে। এসব গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি দলকে লেকচার ভিডিও সাধারণ গতিতে বা ১x গতিতে এবং অন্য দলকে সেই একই ভিডিও দ্রুত গতিতে বা ১.২৫x, ১.৫x, ২x, ২.৫x গতিতে দেখানো হয়।

ঠিক যেমন ঔষধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে ‘র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ বা আরটিসি করা হয় তেমনই এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরও দুইটি দলে এলোমেলোভাবে ভাগ করেছেন গবেষকরা। দুই দলই ভিডিওটি দেখার পর একই ধরনের একটি পরীক্ষা দিয়েছেন। যার মাধ্যমে তারা কতটা শিখেছেন বা মনে রাখতে পেরেছেন তা বোঝার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তথ্য মনে করে লিখতে ও এমসিকিউ এ দুই ধরনের প্রশ্নই করেছেন তারা।

মেটা-বিশ্লেষণের ফলাফলে উঠে এসেছে, ভিডিওর গতি বাড়ানোর ফলে পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যেমন– ভিডিওর গতি ১.৫ গুণ বা ১.৫x পর্যন্ত বাড়ানো হলে খুব সামান্য ক্ষতি হয়। তবে গতি ২ গুণ বা ২x বা তার বেশি করা হলে মস্তিষ্কে মাঝারি থেকে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ প্রসঙ্গে গবেষকরা বলেছেন, কোনও শিক্ষার্থীদের একটি দল সাধারণভাবে পরীক্ষায় গড়ে ৭৫ শতাংশ নম্বর পায় এবং তাদের মধ্যে কারও কমবেশি ২০ শতাংশ পয়েন্টের তারতম্য থাকতে পারে। তবে ভিডিওর গতি ১.৫ গুণ বা ১.৫x করা হলে গড় নম্বর দুই শতাংশ কমে গিয়ে হবে ৭৩ শতাংশ। আর এ গতি ২.৫ গুণ বা ২.৫x করা হলে গড় নম্বর ১৭ শতাংশ কমে হবে ৫৮ শতাংশ। খুব দ্রুত ভিডিও দেখা সময় বাঁচালেও শেখার দিক থেকে সবসময় তা লাভজনক নয়।

বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে প্রভাব

মেটা-বিশ্লেষণের এ গবেষণায় বয়স্কদের ওপরও পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন ৬১ থেকে ৯৪ বছর বয়সী। দ্রুত গতিতে বা টেনে টেনে ভিডিও দেখার সময় তরুণ অর্থাৎ ১৮ থেকে ৩৬ বয়সীদের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন বয়স্করা। গবেষকরা বলছেন, বয়স্কদের স্মৃতিশক্তির দুর্বল থাকার কারণে এমনটি হতে পারে। তবে তারা সুস্থ। বয়স্কদের বিভিন্ন ভিডিও সাধারণ গতি বা ধীর গতিতে দেখা ভালো। এতে ভালোভাবে বুঝতে ও মনে রাখতে পারবেন তারা।

তবে গবেষকরা বলছেন, তারা এখনও জানেন না যে, নিয়ম করে দ্রুত ভিডিও দেখে সেই নেতিবাচক প্রভাব কমানো যায় কি না। হয়ত তরুণরা কেবল দ্রুত ভিডিও দেখার অভিজ্ঞতা বেশি থাকার কারণে এই বাড়তি মানসিক চাপ সামলে নিতে পারেন। একইভাবে এটিও স্পষ্ট নয় যে, তরুণরা দ্রুত ভিডিও দেখে তাদের তথ্য মনে রাখার সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারে কি না। অর্থাৎ, দ্রুত গতির বা টেনে টেনে ভিডিও দেখলে তারা কতটা উপকার বা ক্ষতি পাচ্ছেন, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন গবেষকরা।

আরেকটি অজানা বিষয় হল, গতি বাড়িয়ে ভিডিও দেখার কারণে মস্তিষ্কের কাজ ও মানসিক সক্ষমতায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে কি না। তত্ত্বগতভাবে, এর প্রভাব ভালোও হতে পারে, যেমন বেশি মানসিক চাপ সামলানোর সক্ষমতা বাড়তে পারে। আবার নেতিবাচকও হতে পারে, যেমন বেশি মানসিক ক্লান্তি দেখা দেওয়া। তবে, এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

ভিডিও সাধারণ গতির চেয়ে ১.৫ গুণ গতিতে দেখলেও স্মৃতিশক্তিতে কোনও প্রভাব না পড়লেও গবেষণায় উঠে এসেছে, এ ধরনের ভিডিও দেখা কম আনন্দদায়ক হতে পারে। এটা মানুষের শেখার আগ্রহ ও অভিজ্ঞতার ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে মানুষের শেখার আগ্রহ কমে যেতে পারে। আবার দ্রুত গতি দিয়ে ভিডিও দেখা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে কোনও সমস্যা না-ও হতে পারে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews