‘আমাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা নেওয়া উচিত: সিইসি’—কিছুদিন আগের অতি আলোচিত একটি সংবাদের শিরোনাম এভাবে করেছে প্রতিষ্ঠিত একটি নিউজ পোর্টাল। আমি কৌতূহলবশত এই দেশের প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকা এবং নিউজ পোর্টালের এই সংক্রান্ত রিপোর্টের শিরোনাম খুঁজে দেখেছি। অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিরোনামের ভাষা প্রায় হুবহু এক‌ই।
এটা ‘ইনফরমেশন ওভারলোড’-এর যুগ, তাই এক দশক আগের তুলনায়ও পরিমাণে অনেক বেশি তথ্যে আমরা এক্সপোজড হ‌ই। আর বলা বাহুল্য, সেই তথ্যের মান হয় অনেক কম। তাই আমাদের সামনে কোনও শিরোনাম এলে অনেকেই আর সেটার ভেতরে ঢুকে বিস্তারিত পড়ে দেখি না। আমি আমার পরিচিত কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা কি জানে আমেরিকা বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে শিখতে পারে বলতে সিইসি ঠিক কী বোঝানোর চেষ্টা করেছেন? আমরা কি সবাই জানি, ঠিক কোন প্রসঙ্গে‌ সিইসি এ কথা বলেছেন?
১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ উপনির্বাচনে কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সিইসি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেখানে অনেক কথার মাঝে তিনি বলেন নিচের কথাগুলো—

‘আমাদেরও শেখার আছে আমেরিকা-ইউরোপ থেকে। কোনও সন্দেহ নেই, যেকোনও জায়গা থেকে ভালো শিক্ষা তো আমরা গ্রহণ করি। আর আমারও একটা কথা আছে, আমাদের কাছ থেকেও তাদের শিক্ষাটা নেওয়া উচিত। কারণ, আমেরিকা ৪-৫ দিনেও ভোট গণনা করতে পারে না। আর আমরা ইভিএমের মাধ্যমে চার-পাঁচ মিনিট থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে গণনা করে কেন্দ্রে ঘোষণা দিয়ে দেই। এই জিনিসটা তো আমেরিকার নেই। তাদের প্রায় আড়াই শ’ বছরের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় তো সেটা অ্যাড্রেস করতে এখনও পারেনি।’
তিনি আর‌ও বলেন ‘দ্বিতীয়ত তাদের কোনও সেন্ট্রাল ইলেকশন কমিশন নেই, কেন্দ্রীয়ভাবে নেই। এটা কাউন্টি লেভেলে হয়। ১৩ হাজার কাউন্টি, সেখানে তারা ভোট গণনা করে। তাদের আইন মতো।’
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা নিয়ে আগে কথা বলা যাক। আমেরিকা একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সেখানে তার স্টেটগুলোতে যেমন বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আছে, তেমনি কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল প্রতিষ্ঠানও আছে। যেমন আমেরিকার প্রতিটা স্টেটে সুপ্রিম কোর্ট আছে। তেমনই আবার আছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সুপ্রিম কোর্ট, যার নাম–The Supreme Court of the United States (SCOTUS)।
একটা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ছাড়া আমেরিকা খুব ভালো, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করে আসতে পেরেছে দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে। তাই আমেরিকা বলতেই পারে, একটা ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের আদৌ দরকার নেই। কিন্তু এবারকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর আমার নিজেরও মনে হলো আমেরিকায় একটা ফেডারেল নির্বাচন কমিশন থাকলে সেটা মনে হয় নির্বাচন নিয়ে এবারের মতো সংকট প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারতো।
আমেরিকায় অবশ্য একটা ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব আছে। তবে আমরা জেনে রাখবো, সেটা আমাদেরটির মতো না। এর লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছে–
‘to disclose campaign finance information, to enforce the provisions of the law such as the limits and prohibitions on contributions, and to oversee the public funding of Presidential elections.’ অর্থাৎ এই সংস্থা আসলে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনগুলোর প্রচারণার জন্য ফান্ড তৈরি করা এবং সেটা ব্যয় করা আইন অনুসরণ করে করা হচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করে। আমাদের বা ভারতের নির্বাচন কমিশনের মতো নির্বাচন বিষয়ক সব ক্ষমতা নেই এই প্রতিষ্ঠানের। তেমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকা আমারও মনে হয় মন্দ হতো না। অনুমান করি ভবিষ্যতে আমেরিকায় এইরকম একটি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত কিনা সেই আলোচনা শুরু হবে।
এবার আসা যাক অতি আলোচিত প্রসঙ্গটিতে। আমাদের নির্বাচন থেকে আমেরিকার শেখার আছে বলে যে শিরোনাম করা হয়েছে, তাতে তার বক্তব্য খুবই খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। উনি আমেরিকার নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় লাগার প্রসঙ্গে বলতে চেয়েছেন আমাদের যেহেতু ইভিএম আছে তাই আমরা কয়েক মিনিটেই কেন্দ্রের ফল বলে দিতে পারি। সেই ব্যাপারটা আমেরিকাকে শেখার কথা বলেছেন তিনি। মূলত তিনি ইভিএমের ক্যাম্পেইন করেছেন এখানে।
আমেরিকায় নির্বাচনের ফল প্রকাশে কয়েকদিন কেন লেগে যাচ্ছে সেটা তার অজানা থাকার কথা নয়। ওই দেরি মূলত পোস্টাল ব্যালটের কারণে হয়েছে। হতেই পারে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ওই ভোটগুলো কোনও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত ইভিএমের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারতো। আমি জানি ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বিতর্ক আছে। তবুও তার এই কথা কি আসলে খুব বেশি ‘ফালতু’?
তার বক্তব্যের যে অংশ আমি শুরুতে কোট করেছি, তার শুরুতে খেয়াল করুন। তিনি বলছেন, ‘আমাদেরও শেখার আছে আমেরিকা-ইউরোপ থেকে। কোনও সন্দেহ নেই, যেকোনও জায়গা থেকে ভালো শিক্ষা তো আমরা গ্রহণ করি।’ তার মূল বক্তব্যের আগেই এই কথা বলা প্রমাণ করে তিনি আত্মম্ভরিতা দেখাচ্ছেন না। আমি তার বক্তব্যের ভিডিও দেখেছি এবং তাতে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি আমেরিকাকে শেখার প্রশ্নে তিনি হালকা ঢং-এ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছেন কথাগুলো।
খুব নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করলে বলতে হয় তার এই কথাগুলো বলা অপ্রয়োজনীয় ছিল। তার মতো অবস্থানে থেকে আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ধারণা থাকা একজন মানুষ এমন মন্তব্য না করলেই ভালো হতো। কিন্তু তার এই মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়ঙ্কর। প্রেক্ষাপট এবং ইতিহাস বিবেচনায় না নিলে এই প্রতিক্রিয়াকে অতি বাড়াবাড়ি বলে মনে হতেই পারে। দেশের প্রতিটি মিডিয়া যেভাবে এই সংবাদটি প্রকাশ করেছে তার ‘রিডিং বিটুইন লাইনস’ হচ্ছে–ব্যঙ্গ, তাচ্ছিল্য।
বছরের পর বছর ধরে নানা বিষয়ে ট্রল করে এই দেশের নেটিজেনরা এই ক্ষেত্রে খুব ভালো ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। এই সংবাদের পরের কয়েকদিন অনুমিতভাবেই ফেসবুক ভরে গিয়েছিল তীব্র ট্রলে। নানা বিদ্রূপে সবাই বিদ্ধ করতে থাকেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে। দেশের মূল ধারার এবং সামাজিক মিডিয়ার দিক থেকে এত তীব্র আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা কি ছিল এই বক্তব্যের জন্য?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ কী? একটা উত্তর আছে এরকম–১৯১৪ সালের ১৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড এক সার্বের গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর দুই পক্ষের মৃত ও নাদিরে ধীরে এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বযুদ্ধ হয়।
উত্তরটা একেবারেই শিশুতোষ। ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড যদি হত্যাকাণ্ডের শিকার না হতেন তাহলে কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হতো না? ওই সময়টায় একটা বড় মাপের যুদ্ধ কেন প্রায় অবধারিতই ছিল, সেটা বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখা মানুষ জানেন। তাই তারা বলতে পারবেন ওই ঘটনা না ঘটলেও তার কাছাকাছি সময়ে এরকম বড় একটা যুদ্ধ হতোই। আসলে এর বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে টেনশন এবং শত্রুতা চলছিল বহু বছর ধরেই। ফার্ডিনান্ডের হত্যাকাণ্ড সেই শত্রুটাকে সেই মুহূর্তে যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল মাত্র। আবারও বলছি এই হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও অন্য কোনও ছুতায় এই যুদ্ধ হতোই।
অতীত থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে নানাভাবে  সমালোচনার মুখে ফেলেছেন কয়েকজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তাদের সবার প্রতি যৌক্তিক কারণে মানুষের ক্ষোভ আছে।
এই রাষ্ট্রের অনুষ্ঠিত কোনও নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন হয়েছিল এমন নয়, কিন্তু তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখতো। সবক্ষেত্রে একেবারে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়া জনগণ নিদেনপক্ষে নির্বাচনের ওই একদিন নিজেদেরকে ক্ষমতাবান মনে করার অন্তত ইল্যুশন হতো। তাই এই দেশের নির্বাচন ছিল এক উৎসবের নাম। কিন্তু এখন মানুষের মধ্যে সেই উৎসব আর নেই। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে সেটা খুব স্পষ্ট হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররাও ভোটের প্রতি মানুষের এই চরম অনাগ্রহের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন নানা সময়ে।
এই দেশে একটি সুষ্ঠু অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এর প্রতিটি স্টেকহোল্ডারকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, এমনকি ভোটার। প্রত্যেকের তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা জরুরি। ‌ কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনই হলো নিচের এবং আর সবার সব দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার প্রধান প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলাদেশে যখন কোনও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন এর প্রধান দায় নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আন্তরাষ্ট্রীয় চাপ একটা ঘটনায় যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল, সিইসি’র আমেরিকান নির্বাচন নিয়ে বলা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়াটাও আসলে তাই ছিল। পরিস্থিতি এখন এমনই— সিইসি এখন যে কথাই বলুন না কেন, মানুষ তার সমালোচনা করবে, ট্রল করবে।
তিনি চুপ থাকুন; ‘সূর্য পূর্বদিকে ওঠে’র মতো স্বতঃসিদ্ধ কথা বলাও এখন বিপজ্জনক তার জন্য।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews