বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এ দেশের সরকার ও আইন ব্যবস্থা এখন মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৭ সাল থেকে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি যে এরকম দাঁড়াবে এটা চিন্তা করাও এসব সংগ্রামের সময় সম্ভব ছিল না। কিন্তু আগে যা চিন্তাও করা যেত না এখন বাস্তবত সেই পরিস্থিতির জাঁতাকলে বাংলাদেশের জনগণ অহরহ পিষ্ট হচ্ছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ২৪ বছর ধরে এ দেশের জনগণের ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গণ ও শ্রেণী সংগঠনের ধারাবাহিক সংগ্রামের শীর্ষবিন্দু। জনগণের এই ২৪ বছরের সংগ্রামকে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বিশাল ত্যাগকে বিবেচনার বাইরে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কোনো বিশেষ দল ও ব্যক্তির অবদান হিসেবে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা থেকে ইতিহাস বিকৃতকরণের বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে এটাই হচ্ছে।

কোনো শ্রেণী, রাজনৈতিক দল, সরকার বা ব্যক্তি ইতিহাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের অবিসংবাদী মালিক বা হুকুমদাতা হতে পারে না। সব সময়ের ও সব দেশের ইতিহাস বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ভাষ্য এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। কেউই গায়ের জোরে এই সত্য অস্বীকার করতে পারে না। ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যাদেরই পরিচয় আছে তারা সবাই এ বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত। যাদের সে পরিচয় নেই তারা ইতিহাস চর্চার অযোগ্য এবং ইতিহাস বিষয়ে ‘চূড়ান্ত’ রায় দেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই।

২২ আগস্ট মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে একটি প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে (ভেটিং) প্রাথমিকভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে বা এ ধরনের অপপ্রচারে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তিও হতে পারে।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় এই প্রস্তাব করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৩.০৮.২০১৬)।

এই প্রস্তাবে ‘আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত মীমাংসিত’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যে কোনো আলোচনা ইতিহাস বিষয়ক ব্যাপার। কোনো আদালতই ইতিহাস বিষয়ে গবেষণার সংস্থা নয়। ইতিহাস রচনা বা ইতিহাস বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা কোনো দেশের সুপ্রিমকোর্ট বা হাইকোর্টের কাজ নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী, নেহরু প্রমুখের ভূমিকা ও অবদান অস্বীকার করার কিছু নেই। এজন্য গান্ধীকে ভারতে ‘জাতির পিতা’ও বলা হয়। কিন্তু সেখানে গান্ধীকে ভণ্ড এবং জওহরলাল নেহরুকে বেঈমান ও ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেও অনেক লেখালেখি হয়েছে ও হচ্ছে। অনেক ইতিহাসবিদও এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু এর জন্য ভারতের কোনো সরকার, এমনকি দীর্ঘদিন ভারত শাসন করা রাজনৈতিক দল কংগ্রেস সরকার পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা, তাদের কোনো কথাবার্তাও এ বিষয়ে শোনা যায়নি। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট অথবা কোনো রাজ্যের হাইকোর্টও এ নিয়ে কোনো ‘ঐতিহাসিক মীমাংসা’ ঘোষণা করেনি। ভারতের শাসক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সত্ত্বেও এর মধ্যে তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রমাণ আছে এবং ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে কোনো দায়-দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেয়ার কোনো ব্যাপারই কোনোদিন তাদের থাকেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং তাদের সংঘ পরিবারভুক্ত দল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসে এ ধরনের একটা চেষ্টা করলেও ভারতের জনগণ, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ইতিহাসবিদদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তার হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শুধু ভারত নয়, দুনিয়ায় কোনো দেশ নেই যেখানে ইতিহাস চর্চা এবং কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সরকার বা আদালত কোনো ‘মীমাংসা’ করা তো দূরের কথা, সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এমন এক ধরনের আইন করে জনগণের কণ্ঠ রোধ এবং ইতিহাস চর্চার পায়ে বেড়ি পরানোর ব্যবস্থায় নিযুক্ত হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে বলা দরকার তা হল, মুক্তিযুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকার বিষয়ে সরকারি ভাষ্যের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললে, আলোচনা করলে বা লেখালেখি করলে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে, এটা শাসক শ্রেণী ও তাদের সরকার রচিত সংবিধানেরও পরিপন্থী।

এ প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়েরও উল্লেখ করা দরকার। সরকার জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক বাতিল করার এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, এ প্রসঙ্গে তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতির সমর্থক নই। উপরন্তু তিনি তার শাসনকালে যে অনেক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছিলেন এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাকে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি বা বন্ধু হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায় না, যেমন সেটা করা যায় না অন্য অনেকের ক্ষেত্রেও। কিন্তু তিনি ক্ষমতা দখল করে পরবর্তী পর্যায়ে কী করেছিলেন তার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অস্বীকার করা এক চরম অনৈতিহাসিক কাজ। তিনি ২৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, যা সে সময় সারা দেশের মানুষকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কমান্ডার। এসব দিক দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার যে অবদান ছিল সে তুলনায় স্বাধীনতার পদক তার জন্য কোনো আকাশচুম্বী সম্মাননা নয়। কাজেই যেভাবে এখানে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয় তাতে তাকে স্বাধীনতা পদক দেয়ার মধ্যে অনৈতিহাসিক বা অযৌক্তিক কিছু ছিল না। এ কথা বিশেষভাবে বলা দরকার যে, সরকার এমন লোককেও স্বাধীনতা পদক দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যাদের বিন্দুমাত্র ভূমিকা বা অবদান ছিল না। শুধু আওয়ামী লীগের তল্পিবাহক হওয়ার কারণেই তাদের স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছেন এমন ব্যক্তি যিনি ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডির জন্য বিদেশে থেকে কাজ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না, শুধু সমর্থন ছাড়া। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও আছেন, যারা দেশে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে কোনো সক্রিয় অবদান রাখেননি। আছেন এমন লোকও, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বেতারে প্রোগ্রাম করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আর কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করেননি। এদের সবাইকেই স্বাধীনতা পদক দিয়ে পুরস্কৃত করার একমাত্র কারণ তারা আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও সেবক। এসব যদি ইতিহাস বিকৃতির দৃষ্টান্ত না হয়, তাহলে ইতিহাস বিকৃতি আর কাকে বলে? এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে, ইতিহাস বিকৃতি বিষয়ে কথা বলার জন্য সততা ও শিক্ষা দুইয়ের প্রয়োজনই অপরিহার্য।

২৭.০৮.২০১৬

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল


 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews