আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ঘিরে কঠোর হস্তে আগুনসন্ত্রাস, নাশকতা, নৈরাজ্য দমনের কৌশল গ্রহণের ছক কষছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রার্থী মাঠে নামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র পাল্টে যেতে পারে এমন প্রতিবেদন দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনশ’ নির্বাচনী এলাকার একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে নেতাকর্মী-সমর্থকরা মাঠে নেমে গেলে গা-ঢাকা দেবে আগুন সন্ত্রাসীরা।
নির্বাচনের প্রার্থীদের জনসংযোগে সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে জেলা, উপজেলা, নগর-মহানগরে নির্বাচনী জোয়ার বইতে শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র পাল্টে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের নাশকতা-নৈরাজ্য করে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা-সংঘর্ষের ঘটনায় মহানগরীর বিভিন্ন থানায় গত ১২ দিনের হরতাল-অবরোধের পর রবিবার ও সোমবার চতুর্থ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো। বিগত ১২ দিনের হরতাল-অবরোধের সময়ে যেসব দুর্ধর্ষ আগুন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের যাতে জামিনে মুক্ত হতে না পারে সেজন্য সরকার পক্ষ থেকে আদালতে আপত্তি জানানো হবে। এখনো যারা আগুনসন্ত্রাসের মামলার আসামি হয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আছে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান জোরদার করা হবে।
বাসে আগুনের ঘটনার পর যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে সেই সব মামলার তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা কঠোর হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতির কৌশলের ছক কষা হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী কীভাবে কোথায় কত সংখ্যক মোতায়েন করা হবে, কোথায় কিভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতির মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে পৃথকভাবে বৈঠক করেছে আইনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর হরতাল, অবরোধে যানবাহনে আগুন দেওয়া, নাশকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বৈঠকে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ টানা কত দিনে টেনে নিতে পারবে সেই সক্ষমতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক ও বিস্তৃত হলে আগুনসন্ত্রাসীরা নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের কাছেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই ধরনের প্রতিবেদনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট হতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশন জানুয়ারির শুরুতে ভোটের আয়োজন করতে চায়। নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধের যে কোনো সময় তফসিল ঘোষণা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের হুমকি ও আন্দোলনের মধ্যে তফসিল ঘোষণা ঘিরে সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র্যাব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, আনসার ভিডিপি এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি ও প্রতিনিধিরা অংশ নেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, কোন পদ্ধতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো সভায় আলোচনা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন বাহিনী প্রধান তাদের সক্ষমতা কী আছে, অতীতে তাদের জনবলকে কীভাবে কেন্দ্রে ও অন্য কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে তা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ফিরে যাওয়া, সংঘর্ষ ও গণপরিবহনে আগুনের ঘটনাগুলো ফিরে আসলে তা কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে সেই বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আগুন সন্ত্রাস, নাশকতা ও নৈরাজ্যের চেষ্টা হলে মাঠে পুলিশ র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যরা কঠোর অবস্থানে যাবে। বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ২৮ অক্টোবরের ওই সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং ৪১ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের সংঘর্ষ, নাশকতা, আগুন, ভাঙচুর ও পুলিশ সদস্য হত্যাসহ নানা অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারনামীয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য, অপরাধের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই ধরনের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেছেন, যদি কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে পুলিশ আইনি দায়িত্ব পালন করবে এবং নগরবাসীকে নিরাপদ রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখবে। অতীতে অবরোধের নামে যে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে শুধু ঢাকা নয় সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় তিন মাস অবরোধ করেছিল বিএনপি-জামায়াত। তখন তারা ঘোষণা করেছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ। ঘোষণা দিয়ে ডাকা অনির্দিষ্টকালের সেই অবরোধ কিন্তু পরে তারা আর প্রত্যাহার করেনি। তার মানে হচ্ছে আমরা কিন্তু অবরোধের মধ্যে আছি। সেই অবরোধে তারা পেট্রোল বোমায় মানুষ মেরেছে, পুলিশ হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করেছে। এবার তারা কী করে দেখার বিষয়। অতীতের অবরোধের ইতিহাস তাদের ভালো নয়। সেজন্য অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অত্যন্ত কঠোর ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অতীতের টানা অবরোধের সময় নাশকতা ও সহিংসতা যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি হয়েছিল, সেখানে নিরাপত্তা অধিক জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরেও সব জেলায় কঠোর অবস্থানের নির্দেশনা দেওয়া হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিতে জনগণের জানমালের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলার চেষ্টার ঠেকাতে এবং সরকারি সম্পদ ও কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানসহ সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি উপাসনালয়ে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোটখাটো সব ধরনের পরিস্থিতি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আর অতীত অবরোধের মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া যাবে না।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, দেশব্যাপী আবার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে । এতে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষা করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে র্যাব। কেউ যদি কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতার পরিকল্পনা করে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে র্যাব সার্বক্ষণিক দেশব্যাপী নিয়োজিত থাকবে।