পৃথিবীতে এক মানুষ এসেছিলেন। নাম তাঁর মুহাম্মদ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জগতজুড়ে আলোর বাতি জ্বালিয়েছেন তিনি। মক্কার হেরা গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে কোরআন নামক এক আলো নিয়ে এসে তিনি বলেছেন, ‘পড়ো!’ সে থেকে শুরু হলো, জগৎ আলোকিত করার সবক। আরবের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষগুলো তার ছোঁয়ায় হয়ে উঠল সোনার মানুষ। তাদের ছোঁয়া যাঁরা পেয়েছেন তাঁরাও জগৎ আলোকিত করেছেন নবুওয়তি আলোয়। আসলে নবুয়তি আলো পেতে হলে নবীকে ধারণ করতে হয়। ভালোবাসতে হয়। রসুল (সা.) একাধিক হাদিসে ঘোষণা করেছেন, কেউ যদি তার জীবন, সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র ও বাবা-মায়ের চেয়ে আমি নবীকে বেশি ভালো না বাসে তাহলে সেই ব্যক্তি ইমানদার হতে পারবে না। এক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (সা.) ওমর (রা.)-কে বললেন, হে ওমর! তুমি কি আমাকে তোমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাস? জবাবে ওমর বললেন, হে নবী! আমি আমার সম্পদ, সন্তান, বাবা-মা সবার চেয়ে আপনাকে বেশি ভালোবাসি। তবে আমার জীবনের চেয়ে বেশি এখনো আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি। রসুল (সা.) বললেন, তাহলে মুমিন হতে তোমার এখনো অনেক দেরি আছে। এ কথা শুনে ওমর (রা.) বললেন, হুজুর! এ মুহূর্ত থেকে জীবনের চেয়েও আপনাকে বেশি ভালোবাসি। রসুল (সা.) বললেন, এবার তুমি মুমিন হতে পেরেছ।
সব সাহাবিই রসুলকে তাঁর জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন। হাদিসের কিতাবে এমন এমন আশ্চর্য ঘটনা এসেছে, যেগুলো প্রমাণ করে ভালোবাসার উচ্চতা ছিল হিমালয়পর্বতের চেয়েও বড় এবং গভীরতা ছিল সমুদ্র থেকেও বেশি। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রসুল (সা.) দুপুরে আমাদের ঘরে বিশ্রাম নিতে এলে আমার মা উম্মে সুলাইম হুজুরের জন্য বিছানা করে দিতেন। দয়াল নবীজি যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন উম্মে সুলাইম নবীজির ঘাম ও চুল মোবারক আলাদা করে সংগ্রহ করতেন। অনেক বছর পর যখন আনাস (রা.) মৃত্যুর দুয়ারে, তিনি অছিয়ত করে বললেন, আমার ইন্তেকালের পর রসুলের ঘাম আমার কাফনে মেখে দিও। তার অছিয়ত অনুযায়ী মৃত্যুর পর রসুলের ঘাম তাঁর কাফনে মেখে দেওয়া হলো।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৯২৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) দুপুরে আমাদের ঘরে বিশ্রাম নিতে এলেন। ঘুমের ঘোরে হুজুরের শরীর দরদর করে ঘামছিল। আমার মা উম্মে সুলাইম একটি শিশিতে রসুলের ঘাম মোবারক সংগ্রহ করতে থাকলেন। হঠাৎ হুজুরের (সা.) ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখেন উম্মে সুলাইম ঘাম সংগ্রহ করছেন। নবীজি (সা.) বললেন, হে উম্মে সুলাইম! আপনি এসব কী করছেন? উম্মে সুলাইম বললেন, ‘দয়াল নবীজি! আপনার ঘাম আমাদের আতরের শিশিতে সংগ্রহ করছি। আল্লাহর কসম! আতরের চেয়েও আপনার ঘাম বেশি সুগন্ধিময়।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৩৩১)।
সাহাবায়ে কেরামগণ রসুল (সা.)- কে কেমন ভালোবাসতেন তার একটি উদাহরণ পাওয়া যায় আবু জুহাইফ (রা.)-এর বর্ণনায়। তিনি বলেন, ‘আমি তাবুক অভিযান থেকে ফেরার পথে রসুলকে (সা.) একটি লাল তাঁবুতে দেখেছি। বেলাল (রা.)-কে দেখলাম একটি পাত্রে রসুল (সা.)-এর অজুর অবশিষ্ট পানি নিয়ে এলেন। সেই পানি নেওয়ার জন্য সাহাবিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কে কার আগে নবীজির অজুর পানি নেবে! কেউ সেই পানি খাচ্ছে। কেউ গায়ে মাখছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যাঁরা রসুল (সা.)-এর অজুর পানি পাননি, তাঁরা এমন মানুষের হাতের সঙ্গে হাত, বুকের সঙ্গে বুক মেলাচ্ছেন যাঁরা পানি পেয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৫২১)। উরউয়া বিন মাসুদ বলেছেন, ‘আমি অনেক রাজা-বাদশার দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজাশির দরবারে গিয়েছি। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিরা তাঁকে যেভাবে ভালোবাসে অন্য কোনো রাজা-বাদশার অনুসারীরা তাদের মনিবকে সেভাবে ভালোবাসতে দেখিনি। মুহাম্মদ (সা.)-এর থুতু ফেললে সে থুতু কে নেবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। কারও হাতে যদি থুতু পড়ে সে সঙ্গে সঙ্গে তা গায়ে মাখবে, চেহারায় মাখবে, খেয়ে ফেলবে। তিনি কোনো আদেশ করলে তা সঙ্গে সঙ্গে পালনের জন্য সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। তিনি অজু করলে সেই পানি পাওয়ার জন্য সাহাবিদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। তিনি যখন কথা বলেন সাহাবিরা নিশ্চুপ হয়ে শুনতে থাকেন। সাহাবিরা তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি হবে এই ভয়ে বাঁকা চোখে তাকাতেও সাহস করেন না।’ (বুখারি, ২৫৮২)। প্রিয় পাঠক! ইমানের মূলই হলো নবীপ্রেম। যে যত বেশি নবীপ্রেমে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে, নবীপ্রেমে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে, সে তত বেশি আল্লাহকে পেয়েছে। আমাদের জাতীয় কবি বড় সুন্দর করে বলেছেন, ‘আল্লাহকে যে পাইতে চায়, হজরতকে ভালোবেসে; আরশ কুরসি, লওহ-কলম, না চাইতেই পেয়েছে সে।’ সুবহানাল্লাহ। আসুন! আমরা নবীপ্রেম জানি। নবীপ্রেমের চর্চা করি। আউলিয়ায়ে কেরাম কীভাবে নবীকে ভালোবেসেছেন, সুফিয়ায়ে কেরাম কীভাবে নবীকে মহব্বত করেছেন, সে ঘটনাগুলো জনে জনে বলে বেড়াই। আশা করা যায়, নবীর রহমতের নজর আমাদের ভাগ্যে জুটবে। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
পীর সাহেব, আউলিয়ানগর