“নীলাম্বরী-শাড়ি পরি’ নীল যমুনায় কে যায়?”–নজরুলগীতি। সত্তর ভাগ জলের এই পৃথিবীটাই যেন নীল একটা শাড়ি পরে আছে। এজন্য পৃথিবী শব্দের একটা প্রতিশব্দ ‘সাগরবসনা’, আরেকটা ‘সাগরনেমি’, নেমি শব্দের অর্থ চাকার বেষ্টনী বা বেড়। আবার পদার্থবিদ্যা থেকে জেনেছি সমুদ্রের উপর সূর্যের চেয়ে চাঁদের আকর্ষণ বেশি, কারণ চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি। তাই সমুদ্রে যে জোয়ার-ভাটা হয় তা প্রধানত চাঁদের প্রভাবেই হয়। এজন্য, চন্দ্রোদয়ে যে ক্লিন্ন হয় অর্থাৎ চাঁদ উঠলে যে ভিজে যায়, প্রাচীন অভিধানে তাকে বলা হচ্ছে সমুদ্র।
স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছিলেন, “আমি কেবল সমুদ্রের তীরে খেলাধুলা করা একটি ছেলের মতো এবং মাঝে মাঝে নিজেকে কিছু ঝকঝকে নুড়িপাথর বা মধ্যম সৌন্দর্যের ঝিনুক খুঁজে বের করার মধ্যে ডুবিয়ে রাখছি, যেখানে সত্যের বিশাল সমুদ্র আমার সামনে অনাবিষ্কৃত অবস্থায় পড়ে আছে।” নিজের অর্জিত জ্ঞানের সামান্যতা বোঝাতে তিনি তাকে অসীম মহাসাগরের অজানা জ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কথাটা বিনয়সূচক ও রূপকার্থে হলেও আজকের বিজ্ঞানও সে কথা বলছে; সমুদ্রবিজ্ঞানের উদাহরণ দেখা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে ৯০ শতাংশেরও বেশি সামুদ্রিক জৈব প্রজাতি এখনও নথিভুক্ত (documented) করা সম্ভব হয়নি, এদের মধ্যে মাছ এবং ক্রাস্টেসিয়ান থেকে শুরু করে মাইক্রোবিয়াল আর্কিয়া এবং গভীর সমুদ্রের স্পঞ্জ রয়েছে। পৃথিবীর চূড়ান্ত সীমানা সমুদ্র হল অজানা জীববিজ্ঞানের একটি রাজ্য, যেখানে প্রতিটি ডুব পাঠ্যপুস্তক পুনর্লিখনের জীবরূপ প্রকাশ করে।
সমুদ্র-প্রাণিজগতের যে দশ ভাগ সম্বন্ধে মানুষ জানতে পেরেছে, তা ইতোমধ্যে মানবজাতির জন্য বিস্ময়কর বিবিধ কল্যাণ বয়ে এনেছে। অ্যারেনিকোলা মেরিনা (Arenicola marina) একটি সামুদ্রিক কীট যা সাধারণত লাগওয়ার্ম (lugworm) বা ব্লো লাগওয়ার্ম (blow lugworm) নামে পরিচিত এবং সৈকতের যেখানে জোয়ার-ভাটার পানি আসা যাওয়া করে এমন বালুকাময় বা কর্দমাক্ত জায়গায় ইউ (U)-আকৃতির গর্তে বাস করে। লাগওয়ার্ম এক ধরনের অ্যানিলিড (annelid), দেখতে কিছুটা এদেশের ফেরেটিমা প্রজাতির কেঁচোর মত (তবে কেঁচো নয়), ১০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা, গোলাপী, বাদামী বা কালো রঙের হতে পারে। বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে যে লাগওয়ার্মের হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা মানুষের হিমোগ্লোবিনের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি। এই জ্ঞান তারা কাজে লাগান অঙ্গ প্রতিস্থাপনের (organ transplant) অপারেশনে। দেহের যে কোন কোষ (cell) বা টিস্যুর বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানবদেহে অক্সিজেন ছাড়া ব্রেইন কোষ ৪ থেকে ৬ মিনিট, হার্ট কোষ ১৫-২০ মিনিট, কিডনি কোষ ২-৩ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। কোষে কোষে অক্সিজেন পরিবহন ও সরবরাহের গুরত্বপূর্ণ কাজটা করে থাকে রক্তের হিমোগ্লোবিন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রোগীর দেহে প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত অঙ্গদাতা (donor)-এর অঙ্গ (যেমন কিডনি, লিভার, হার্ট ইত্যাদি) টিকিয়ে রাখা, কারণ মধ্যবর্তী সময়ে অক্সিজেন স্বল্পতার ফলে কোষের প্রভূত ক্ষতি হয়ে যায়, যাকে ischemia-reperfusion injury (IRI) বলে। মধ্যবর্তী সময়ে অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য সাধারণত শীতলকরণ (cooling) এবং UW (University of Wisconsin Solution) দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। শীতলকরণ পদ্ধতিতে দাতার অঙ্গ জীবাণুমুক্ত বরফের একটি ব্যাগে (অথবা 0-4°C তাপমাত্রায় কোল্ড স্টোরেজে) সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে কিডনি (উদাহরণত) সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু এতে ৪০-৬০শতাংশ কোষের ক্ষতি সাধিত হয়, ফলে প্রায় ৫০শতাংশ কিডনিই ব্যবহার উপযোগী থাকে না, ফেলে দিতে হয়। আর UW দ্রবণে অঙ্গ ডুবিয়ে তারপর 4°C তাপমাত্রায় ফ্রিজে রাখা হয়। এভাবে কিডনি সর্বোচ্চ ৩৬ ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ কোষের ক্ষতি হয়ে যায়, ফলে প্রায় ১০-৩০ শতাংশ কিডনি ব্যবহার উপযোগী থাকে না। দুটি পদ্ধতিই বিপাক ধীর করে দেয় এবং ফোলা/অ্যাসিডোসিস প্রতিরোধ করে। কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহ করে না–যেজন্য ধীরে ধীরে অঙ্গগুলোর দম বন্ধ হয়ে আসে। অপরদিকে, UW দ্রবণ বা বিশেষায়িত বাফারের মত সংরক্ষণ দ্রবণে যদি লাগওয়ার্ম হিমোগ্লোবিন (Hemo2Life বা M101 নামে পরিচিত) যোগ করা হয় তবে কিডনি/লিভার দীর্ঘসময় (৫০ ঘণ্টার বেশি) বেঁচে থাকে, ১০ শতাংশের কম কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারণ গ১০১ অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখে, বিষাক্ত মুক্ত-র্যাডিক্যাল তৈরি করে না বা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ট্রিগার করে না; আখেরে দাতার কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
জেরোম হ্যামন নামক একজন ফরাসি নিউরোফাইব্রোমাটোসিস টাইপ ১ (NF1) থেকে মুখমণ্ডলের বিকৃতিতে ভুগছিলেন, যা একটি জেনেটিক ব্যাধি। প্রথমে ২০১০ সালে ফ্রান্সেই তার আংশিক মুখ প্রতিস্থাপন (নিচের চোখের পাতা, নাক, ঠোঁট) করা হয়। কিন্তু ৮ বছর পর ওই গ্রাফ্ট তার শরীর প্রত্যাখ্যান করে। জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতা দেখা দেয়, তিনি সঠিকভাবে খেতে, কথা বলতে বা চোখের পলক ফেলতে পারছিলেন না। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মত তার মুখ প্রতিস্থাপন করা হয়; এবারে ফরাসী চিকিৎসক লরেন্ট ল্যান্টেরি (জর্জেস পম্পিডো হাসপাতাল, প্যারিস) দাতার মুখ সংরক্ষণে M101 ব্যবহার করেন। মুখটি একজন ব্রেন-ডেড দাতার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং প্রতিস্থাপনের আগে M101 দ্রবণে তা ২৪ ঘণ্টার বেশি সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। অভূতপূর্ব সফলতা অর্জিত হয়, রোগীর মুখের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার হয় (চোখের পলক ফেলা, কথা বলা ইত্যাদি)। প্রমাণিত হয় যে সামুদ্রিক হিমোগ্লোবিন (M101) অত্যন্ত জটিল রক্তনালী সমৃদ্ধ অঙ্গ (vascularized graft) দীর্ঘসময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম। এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পথ প্রশস্ত করে। ২০১৯-২০২০ ফ্রান্সে ডা. ফ্রাঁসোয়া কেরবাউল কিডনি প্রতিস্থাপনে প্রথমবারের মত M101ব্যবহার করে সফলতা অর্জন করেন। ২০২১ সালে ভারতের কোচির অমৃতা হাসপাতালের সার্জন ডা. সুব্রামানিয়া আইয়ার প্রথম দুই অগ্রবাহু (কনুই এবং কব্জির মাঝখানে) প্রতিস্থাপন করেন। ৩৪ বছর বয়সী একজন পুরুষ সড়ক দুর্ঘটনায় তার দুই অগ্রবাহু হারিয়েছিলেন। ব্রেইন ডেড দাতার বাহু M101-এ ৪৮ ঘণ্টার বেশি সংরক্ষিত ছিল। রোগী কয়েক মাসের মধ্যে মুঠিবদ্ধ করার শক্তি এবং সংবেদন ফিরে পান এবং ধীরে ধীরে উভয় বাহুরই কার্যকারিতা ফিরে পান। কিছু প্রিক্লিনিক্যাল ব্রেকথ্রুও অর্জিত হয়েছে। ২০২১ সালে জার্মানিতে M101-এ সংরক্ষিত শুকরের লিভার, ২০২২ সালে ফ্রান্সে ইঁদুরের হৃদপিণ্ড কয়েক গুণ বেশি সময় বেঁচে থেকেছে এবং মানবদেহে M101 দিয়ে সংরক্ষিত লিভার, হার্ট প্রতিস্থাপনের পথ সুগম করেছে।
ভারতবর্ষীয় পৌরানিক কাহিনিতে সমুদ্রমন্থনের মাধ্যমে সর্বরোগের মহৌষধ আবিষ্কারের ঘটনা রয়েছে। অসুরদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের লক্ষ্যে দেবতাগণ ঠিক করেন যে তারা সমুদ্রমন্থনের মাধ্যমে অমৃত সংগ্রহ করবেন। ক্ষীরসাগরে সমুদ্রমন্থনের প্রক্রিয়ায় মন্দার পর্বত মন্থনদণ্ড হিসাবে এবং শিবের স্কন্ধসঙ্গী নাগরাজ বাসুকী মন্থনরজ্জু হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রমন্থনের ফলে ক্ষীরসাগর থেকে বিবিধ রত্ন, দৈবপশু, দেবী, চন্দ্র, ধন্বন্তরী ইত্যাদি উত্থিত হয়। ধন্বন্তরী হলেন দেবতাদের চিকিৎসক। সমুদ্রমন্থনের একেবারে শেষে এই ধন্বন্তরী অমরত্বের পীযূষ স্বরূপ একটি অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে উত্থিত হন। অমৃত পান করে দেবতারা অমরত্ব লাভ করেন এবং অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হন। বাস্তবে অমরত্বের ওষুধের সন্ধান পাওয়া না গেলেও সামুদ্রিক জীবজগৎ থেকে বেশ কিছু যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন:
১. জিকোনোটাইড (Ziconotide): দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা উপশম করে। উৎস: শঙ্কু শামুক Cone snail (Conus magus)-এর বিষ। প্রক্রিয়া: স্নায়ুতে N-টাইপ ক্যালসিয়াম চ্যানেলগুলোকে ব্লক করে। ওপিওয়েড (Opioid)-এর মত আসক্তি তৈরি করে না, তীব্র দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার জন্য জীবন রক্ষাকারী (যেমন, ক্যান্সার, এইচআইভি রোগীদের)।
২. এরিবুলিন (Eribulin): ক্যান্সার কেমোথেরাপি। উৎস: স্পঞ্জ (Halichondria okadai)। প্রক্রিয়া: মাইক্রোটিউবুলের গতিশীলতাকে বাধা দিয়ে ক্যান্সার কোষ বিভাজন বন্ধ করে। চিকিৎসা-প্রতিরোধী (resistant) টিউমারের উপর কাজ করে (যেমন, মেটাস্ট্যাটিক স্তন ক্যান্সার) বেঁচে থাকার সময়কাল দীর্ঘায়িত করে।
৩. ট্রাবেকটিডিন (Trabectedin): নরম টিস্যু সারকোমা এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারে কার্যকর। উৎস: সামুদ্রিক স্কুইর্ট (Ecteinascidia turbinata)। প্রক্রিয়া: DNA আবদ্ধ করে, ক্যান্সার কোষের প্রতিলিপি এবং টিউমারের মাইক্রোএনভায়রনমেন্ট ব্যাহত করে। বিশেষত্ব হচ্ছে ক্যান্সার কোষ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দমনকারী কোষ উভয়কেই লক্ষ্য করে, ফলে বিরল ও আক্রমণাত্মক ক্যান্সারের জন্য উন্নত ফলাফল বয়ে আনে।
৪. গ্রিফিথসিন (Griffithsin): অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ । উৎস: লাল শৈবাল (Griffithsia)। প্রক্রিয়া: ভাইরাল প্রোটিনকে আবদ্ধ করে HIV এবং SARS-CoV-2 প্রবেশকে বাধা দেয়।
৫. স্কোয়ালামাইন (Squalamine) - অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টি-অ্যাঞ্জিওজেনিক। উৎস: ডগফিশ হাঙ্গরের লিভার। প্রক্রিয়া: রোগজীবাণুগুলির কোষের ঝিল্লি বিনষ্ট করে এবং টিউমারে রক্তনালীর বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। সুপারবাগ এবং চোখের রোগের বিরুদ্ধে অভিনব পদ্ধতি।
‘ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার অফ মেরিন স্পিসিজ’ অনুসারে আনুমানিক ২২ লক্ষ সামুদ্রিক প্রজাতির মধ্যে মাত্র ২,৪০,০০০টি আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয়েছে (মাত্র ১০ শতাংশ)। এমনকি নামকরণকৃত প্রজাতির ১শতাংশেরও কমের জৈব-রাসায়নিক সম্ভাবনা জানার জন্য বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। সামুদ্রিক প্রাণিজগৎকে একটি লাইব্রেরির সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, আমরা মাত্র ১০ শতাংশ বই তালিকাভুক্ত করতে পেরেছি, তন্মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ বই পড়তে পেরেছি। আবার এই ১ শতাংশেরও অনেক গোপন রহস্য আজও ভেদ করা হয়নি। উদাহরণ: ডিসকোডার্মিয়া স্পঞ্জ (১৯৮০ সাল থেকে পরিচিত) ক্যান্সার-বিরোধী ডিসকোডার্মোলাইড উৎপন্ন করে। কিন্তু ডিসকোডার্মোলাইডকে একটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল ওষুধে রূপান্তরিত করতে ২৫ বছর সময় লেগেছে! কিন্তু ডিসকোডার্মোলাইড কীভাবে সংশ্লেষিত হয় তা আজও সম্পূর্ণরূপে ডিকোড করা যায়নি, সকল ধরনের ক্যান্সারে কার্যকর কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি, ব্যাপকভাবে উৎপাদনের ব্যবস্থাও করা যায়নি।
কাহলিল জিবরান বলেছিলেন, ‘এক ফোঁটা জলেই পুরো মহাসাগরের সমস্ত রহস্য খুঁজে পাওয়া যায়’।
মহাসাগর শুধু যে তার জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত চিকিৎসা অগ্রগতি প্রদান করে চলেছে তা নয়, সৃষ্টি থেকেই মহাসাগরের সম্পূর্ণ ডিনামিক্স আমাদের সেবায় নিয়োজিত আছে। মহাসাগর পৃথিবীপৃষ্ঠের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত এবং এদের গড় গভীরতা ৩.৭ কিমি, যা একটি বিশাল ত্রিমাত্রিক আবাসস্থল (habitat) তৈরি করেছে। সমগ্র স্থলজ আবাসস্থলের মিলিত আয়তনের চেয়ে মহাসাগরগুলো অনেক বেশি আয়তন ধারণ করে। ফলে মহাসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম বাস্তুতন্ত্র (ecosystem), যা গ্রহের বাসযোগ্য স্থানের ৯৯ শতাংশেরও বেশি জুড়ে রয়েছে (ভূগর্ভস্থ জীবজগৎ ব্যতিরেকে)। মহাসাগর জীবনের বৃহত্তম উৎস, যেখানে পার্থিব সমস্ত জীবনের ৫০-৮০ শতাংশ রয়েছে। তাছাড়া, মহাসাগর গ্রহের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং মানুষের দ্বারা উৎপাদিত প্রায় ৩০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবকে প্রতিহত করে। একটি অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের ফলে যে পরিমাণ তাপ উৎপাদিত হয় মহাসাগর প্রতি সেকেন্ডে সেই পরিমাণ তাপ শোষণ করে থাকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল এটি এবং বিশ্বজুড়ে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রোটিনের প্রধান উৎস। মহাসাগর আমাদের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ৪ কোটি মানুষ সমুদ্রভিত্তিক শিল্পে নিযুক্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের চেয়ে সমুদ্র বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে। মহাকাশ অনুসন্ধান কল্পনাকে মোহিত করলেও, সমুদ্রবিজ্ঞান মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, তা বাস্তব সুবিধাদি প্রদান করে। জ্যোতির্বিদ্যাগত মহাকাশচুম্বী ব্যয়ের (যেমন, মঙ্গল অভিযানের পরিমাণ ২.৭ বিলিয়ন ডলার) বিপরীতে সমুদ্র গবেষণা দ্রুতগতিতে, সাশ্রয়ী ব্যয়ে তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবেলা করে। সমুদ্র আমাদের জীবন সহায়ক ব্যবস্থা–এটি বোঝা এবং নিরাময় করা কোনও পছন্দ নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয়তা। মহাকাশ অপেক্ষা করতে পারে, সমুদ্র পারে না।
আমাদেরকে অগণিত সহায়তা করলেও মহাসাগরের নিজেরই এখন সহায়তার প্রয়োজন। বৃহদাকার মাছের সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমে যাওয়ায় এবং প্রবাল প্রাচীর ৫০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এটা প্রতীয়মান হয় যে আমরা সমুদ্র থেকে তার চেয়ে বেশি কিছু নিচ্ছি যা পূরণ করা সম্ভব নয়। সাগর-মহাসাগর মারাত্মক দূষণের শিকার। প্লাস্টিক এবং আবর্জনা মহাসাগরে ফেলা হচ্ছে; জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে প্রতি বছর ৮-১৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে, প্রতিদিনের হিসাবে যা ২২,০০০-৩৮,০০০ টন। এর ৮০ শতাংশ আসে স্থল থেকে (নদী, আবর্জনা, অব্যবস্থাপিত বর্জ্য)। বাকি ২০ শতাংশ আসে সামুদ্রিক উৎস থেকে; যেমন: হারিয়ে যাওয়া বা পরিত্যক্ত মাছ ধরার সরঞ্জাম (জাল, নাইলন, ফাঁদ) (১০ শতাংশ), মালবাহী জাহাজের বর্জ্য (কন্টেইনার, প্যাকেজিং, রঙের মাইক্রোপ্লাস্টিক)। উল্লেখ্য, শীর্ষ ৫টি দূষণকারী নদী–গঙ্গা (ভারত), সিন্ধু (পাকিস্তান), ইয়াংজি (চীন)–নদীবাহিত প্লাস্টিকের ৯০ শতাংশ বহন করে। আবার জলের অম্লীকরণ (acidification) নীরবে আরেক মহাসংকট তৈরি করেছে। সমুদ্র মানুষের CO₂ নির্গমনের যে ৩০ শতাংশ শোষণ করে, তা রাসায়নিক বিক্রিয়ার সূত্রপাত করে, CO₂ পানির সঙ্গে মিশে কার্বনিক অ্যাসিড (H₂CO₃) সৃষ্টি করে, pH কমে যায়, পানির অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি পায়। ১৮০০ সাল থেকে pH ৮.২ থেকে ৮.১ এ নেমে এসেছে (৩০ শতাংশ অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি), ২১০০ সালের মধ্যে ঢ়ঐ ৭.৮-এ পৌঁছাতে পারে। অ্যাসিডিফিকেশন সমুদ্রকে ক্ষয়কারী করে তুলছে–খাদ্য শৃঙ্খলের জন্য হুমকি ডেকে আনছে। কার্বনেট আয়ন ৩০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ায় শেলফিশ (যেমন ঝিনুক) ও প্রবাল নিজেদের কঙ্কাল তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঝিনুক হ্যাচারিগুলোতে অ্যাসিডিফিকেশনের কারণে ৮০শতাংশ লার্ভা মৃত্যুঝুঁকিতে, বাধ্য হয়ে অ্যান্টাসিড দিয়ে জল বাফার করা হচ্ছে। শক্ত খোলসের প্ল্যাঙ্কটন (plankton) কোকোলিথোফোর এবং টেরোপড কঙ্কাল তৈরিতে সংগ্রাম করছে। অথচ প্লাঙ্কটন সমুদ্রের কার্বনের ৩০শতাংশ হজম করে; টেরোপড স্যামন, হেরিং এবং তিমির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। ২১০০ সালের মধ্যে প্লাঙ্কটনের সংখ্যা ৪০শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব, কিন্তু পরিণতি টাইটানিক।
এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ ২০২১-২০৩০ সালকে ‘সমুদ্র বিজ্ঞান দশক’ (Decade of Ocean Science) ঘোষণা করে, যার ভিশন ‘আমাদের সেই বিজ্ঞান প্রয়োজন, যা মহাসাগরের জন্য প্রয়োজন’। আবার ২০২৫-২০৩৪ সময়কালকে জাতিসংঘ ‘ক্রায়োস্ফিয়ারিক বিজ্ঞানের জন্য কর্মের দশক’ (Decade of Action for Cryospheric Sciences) হিসেবে পালন করছে। হিমবাহ (glacier), তুষার (snow), বরফ (ice) এবং পারমাফ্রস্টের (permafrost) সমন্বয়ে গঠিত ক্রায়োস্ফিয়ার (crysophere) পৃথিবীর জলবায়ু (যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের স্তর নিয়ন্ত্রণ) এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা (যেমন মানুষের জন্য মিঠা পানির প্রাপ্যতা) নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্রায়োস্ফিয়ার গলে যাওয়ার ফলে বিপর্যয়কর প্রাকৃতিক ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে, পারমাফ্রস্টে আটকে থাকা গ্রিনহাউস গ্যাস বেরিয়ে আসছে।
তাছাড়া প্রতিবছর ৮ জুন ‘বিশ্ব মহাসাগর দিবস’ (World Oceans Day) উদযাপিত হয়। ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘আশ্চর্য! যাদের জন্য আমরা টিকে আছি, তাদের টিকে থাকাই দায়’ (Wonder: Sustaining what sustains us)। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, দিনটি সেই বিস্ময় উদযাপন করে যা সমুদ্র আমাদের মধ্যে অনুপ্রাণিত করে: এর সৌন্দর্য, এর রহস্য এবং আমাদের জীবনে এবং গ্রহে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই দিনটি সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের গভীর সংযোগের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং কৌতূহল, প্রজ্ঞা এবং সম্মিলিত কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দ্বারা পরিচালিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এর সুরক্ষার আহ্বান জানায়।
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে মামলা উচ্চতর আদালতে গড়ায়। জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত International Tribunal for the Law of the Sea (ITLOS) ১৪ মার্চ ২০১২ তারিখে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে রায় প্রদান করে। আবার নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত The Permanent Court of Arbitration ৭ জুলাই ২০১৪ তারিখে ভারতের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশের পক্ষে রায় প্রদান করে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত ওই ২টি মামলায় জয় লাভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের সমান এই এলাকার সম্পদের সুষ্ঠু ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) বৈশ্বিক ধারণা ও কৌশল বিশেষ গুরত্ব লাভ করে। ব্লু ইকোনমি মহাসাগর এবং সমুদ্রকে ‘উন্নয়ন স্থান’ হিসাবে ধারণ করে, যেখানে স্থানীয় পরিকল্পনা সংরক্ষণ, জীবন্ত সম্পদের টেকসই ব্যবহার, তেল ও খনিজ সম্পদ উত্তোলন, জৈব-প্রত্যাশা, টেকসই শক্তি উৎপাদন এবং সামুদ্রিক পরিবহনকে একীভূত করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। জলসম্পদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য প্রভাব প্রশমনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অনুমোদন করে। ‘নিরাপদ, জলবায়ু সহনশীল এবং সমৃদ্ধ ডেল্টা অর্জন’-কে ভিশন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যাক্ট (BORI) ২০১৫ সালে সংসদে অনুমোদিত হয় এবং ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা শুরু হয়। সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা ও দক্ষ জনবল তৈরিতে BORI ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। BORI বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক শৈবালের পুষ্টিকর ক্ষমতা নথিভুক্ত করেছে, ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহার্য সামুদ্রিক শৈবালের সালফেটেড পলিস্যাকারাইড সম্পর্কে সীমিত কিন্তু আশাব্যঞ্জক উপাত্ত সংগ্রহ করেছে, সামুদ্রিক শৈবালের ভারী ধাতু শোষণের উপর গবেষণা করেছে, যা পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে প্রয়োগ করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের ফ্যাকাল্টি অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বঙ্গোপসাগরের স্পঞ্জে (যেমন হ্যালিক্লোনা) অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল যৌগ আবিষ্কার করেছে, নরম প্রবালে (যেমন সিনুলারিয়া) অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগ সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ থেকে এক ধরনের নতুন ছত্রাক আবিষ্কার করেছে যাদের অ্যান্টিবায়োটিক কর্মক্ষমতা বিদ্যমান, ম্যানগ্রোভ এন্ডোফাইটে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং সাইটোটক্সিক যৌগের সন্ধান পেয়েছে। ফলাফলগুলো বাংলাদেশে ভবিষ্যতের সামুদ্রিক ওষুধ বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্ভাবনা বিপুল। বঙ্গোপসাগরে হাজার হাজার অনথিভুক্ত প্রজাতি থাকতে পারে–তাদের মধ্যে অনারোগ্য বা দুরারোগ্য রোগ নিরাময় বা জলবায়ু সমাধান লুকিয়ে থাকতে পারে। স্পঞ্জের মাইক্রোবায়োম (ব্যাকটেরিয়া/ছত্রাক) অন্যান্য অজানা ওষুধ ধারণ করতে পারে। সমুদ্র উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভে এমন ধরণের জীবাণু আছে যেগুলো CO₂ হজম করে–এরা কার্বন-সংরক্ষণকারী জলবায়ু-নায়ক। সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টেও কার্বন-সংরক্ষণকারী অসংখ্য জীবাণু বসবাস করে। এসব জীবাণুর গোপন রহস্য আজও ভেদ করা হয়নি। আমরা জানি তারা CO₂ কে আলাদা করে রাখে, কিন্তু কীভাবে এগুলোকে ব্যাপকভাবে কার্বন ক্যাপচারের জন্য ব্যবহার করা যায় তা জানি না। মুশকিল হচ্ছে পূর্বোক্ত আবিষ্কারসমূহের এখনও কোনও বাণিজ্যিকীকরণ হয়নি, কোনও ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়নি। ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলি উচ্চ-মূল্যের সামুদ্রিক ওষুধ গবেষণা ও উন্নয়নের পরিবর্তে জেনেরিক ওষুধের (কম-ঝুঁকিপূর্ণ, উচ্চ-লাভজনক) উপর নির্ভরশীল থাকে। দেশে এখনও কোনও নিবেদিত সামুদ্রিক জৈব-সম্ভাবনা ল্যাব (bioprospecting lab) নেই, কিছু জৈব-রসায়ন বিভাগ সামুদ্রিক নমুনা বিশ্লেষণ করে থাকে মাত্র। সামুদ্রিক জৈব-প্রসপেক্টিংয়ের জন্য নিষ্কাশন, সংশ্লেষণ এবং পরীক্ষায় উচ্চ বিনিয়োগ প্রয়োজন। সামুদ্রিক জৈব-সম্ভাবনা সম্পর্কিত (bioprospecting) কোনও জাতীয় নীতি আমাদের নেই (ভারতের CSIR-NIO বা ইন্দোনেশিয়ার LIPI-এর বিপরীতে)। বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু এখনও কোনও পাইপলাইন নেই। নীতিগত সংস্কার এবং শিল্প-শিক্ষা সম্পর্ক সামুদ্রিক জৈব-ফার্মাকে উন্মোচন করতে পারে।
সমুদ্র-ভিত্তিক ওষুধ আবিষ্কার জীববৈচিত্র তথা পরিবশের ক্ষতি করছে কি না সে সম্পর্কে আলোচনা এবং কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী চলমান রয়েছে। অনেক সামুদ্রিক জৈবযৌগ এখন ল্যাব বা খামারে চাষ করা হয়। যেমন: ফ্রেঞ্চ কোম্পানি হেমারিনার মতো কোম্পানিগুলি লাগওয়ার্ম চাষ (অ্যাকুয়াকালচার) করে (হিমোগ্লোবিনের জন্য)। ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ এরিবুলিন মূলত স্পঞ্জ থেকে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এখন আধা-সংশ্লেষণের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় (সাগর থেকে গণসংগ্রহের মাধ্যমে নয়)। জৈবপ্রযুক্তির বিকল্প সংস্করণ ও সিনথেটিক ওষুধও উৎপাদিত হচ্ছে; জিন বিচ্ছিন্ন করা বা ব্যাকটেরিয়াজনিত গাঁজন ব্যবহার করে সামুদ্রিক যৌগের প্রতিলিপি তৈরি করা হয়। স্কোয়ালামাইন (হাঙ্গর থেকে প্রাপ্ত), জিকোনোটাইড (শামুকের বিষজাত) কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত হচ্ছেÑসামুদ্রিক শামুক সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ছে না। ঈজওঝচজ এবং শৈবালের বায়োরিয়েক্টর সামুদ্রিক সংগ্রহের স্থান নিতে পারে। প্রবাল ও স্পঞ্জ পুনরুদ্ধারকল্পে সামুদ্রিক পারমাকালচার চালু হয়েছে; ফ্লোরিডার গবেষকরা কৃত্রিম প্রবাল-প্রাচীরে ব্রায়োজোয়ান (ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধের উৎস) চাষ করেন। বিপন্ন সামুদ্রিক প্রজাতির বাণিজ্য সীমিত করা হচ্ছে। প্রবিধানের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে; CITES (বিপন্ন প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলন) এবং নাগোয়া প্রোটোকল অতিরিক্ত সমুদ্র আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। ‘সুরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকা’ (Marine Protected Area=MPA), যেখানে সংগ্রহ নিষিদ্ধ, চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মাত্র ২টি এমপিএ (সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড এবং নিঝুম দ্বীপ), কিন্তু সেখানেও তত্ত্বাবধান দুর্বল।
সমুদ্র দূষণ রোধে নীতিগত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পাতলা প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ; ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সালে সংশোধিত) এর ধারা ৬ক এর অধীনে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার (উৎপাদন, আমদানি, বিপণন, বিক্রয় ইত্যাদি) নিষিদ্ধ করে। প্রাথমিকভাবে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার ৮০ শতাংশ হ্রাস পায়, যদিও আইনের প্রয়োগ এখনও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন ২০২১ সালে একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ নীতিমালা গ্রহণ করে; ১০টি শীর্ষ প্লাস্টিক দূষণকারী (কাটলারি, স্ট্র, স্টাইরোফোম পাত্র) নিষিদ্ধ করে; ইতোমধ্যে ইইউ সৈকতজুড়ে এই জিনিসপত্রের আবর্জনার পরিমাণ ৫০-৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে; ২০৩০ সালের মধ্যে নিষিদ্ধ পণ্যের সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য ৭০ শতাংশ কমানোর আশা করা হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় মাইক্রোবিডস নিষিদ্ধকরণ (২০১৮) আইন করা হয়েছে, প্রসাধনীতে প্লাস্টিকের মাইক্রোবিডস নির্মূল করা হয়েছে, যা সমুদ্রে প্রতি বছর ১.৪ মিলিয়ন কেজি CO₂ প্রবেশ রহিত করেছে।
সমুদ্রমন্থনের ফলে অমৃতের পূর্বে বিষ উত্থিত হয়েছিল। শিব এই হলাহল পান করে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে সকলকে রক্ষা করেন; বিষে বিষে তার কণ্ঠ নীল হয়ে যায়; এই জন্য তার আরেক নাম নীলকণ্ঠ। মহাসাগরের জীবজগৎ নীলকণ্ঠ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সামুদ্রিক জৈব-চিকিৎসা তথা বিজ্ঞানকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে উদ্ভাবন এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচারের মধ্যে- মহাসাগর এবং তার রক্ষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সমুদ্রের সঙ্গে এই ভারসাম্য তৈরি করার জন্য মানবজাতিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যা আর এর সম্পদ হ্রাস করবে না বরং এর প্রাণবন্ততা পুনরুদ্ধার করবে এবং এটিকে নতুন জীবন দেবে। সমুদ্রকে টিকিয়ে রাখা মানে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখা। এর স্রোতকে আমাদের নিজস্ব হৃদস্পন্দনের মতোই অনুভব করতে হবে, রক্ষা করার জন্য প্রচণ্ডভাবে চেষ্টা করতে হবে। ইংরেজি একটা কথার বাংলা: সকল কষ্টের নিরাময় হচ্ছে নোনাজল–ঘাম, অশ্রু অথবা সমুদ্র।