মুসলিম বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ কীভাবে ২২ বছরে (১৯৮১-২০০৩) একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে মালয়েশিয়া তার উদাহরণ। পেশায় চিকিৎসক একজন রাজনীতিবিদের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে এই বিস্ময়কর সাফল্য। মালয়েশিয়ার উন্নয়নের মহানায়ক ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। এই মহান রাজনীতিবিদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর দেশে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন, তার কোনো তুলনা নেই। ডা. মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ পদে দায়িত্ব পালন করেন টানা ২২ বছর। তারপর রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তাঁর উত্তরসূরিদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৮ সালে ৯৩ বছর বয়সে আবার ফিরে আসেন রাজনীতিতে। ওই বছরই প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। মাহাথির মোহাম্মদ একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও তাঁর দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বানাননি। তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে দুর্নীতিতে জড়ানোর ভ্রান্তিতে ভোগেননি। যেমনটি ঘটেছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত শুধু নয়, তারা লুটপাটের মৃগয়াক্ষেত্র বানিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বানাবার যে অপকৌশল বেছে নিয়েছিলেন, তা তাঁর নিজের জন্য কল্যাণকর হয়নি। এ অপকর্মের অনিবার্য পরিণতি ছিল গত বছরের জুলাই গণ অভ্যুত্থান।

শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোনের ছেলে রাদওয়ান মুজিব ববি, বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, চাচাতো ভাই শেখ হেলাল এবং নতুন প্রজন্ম শেখ তন্ময়, শেখ তাপস, শেখ পরশ, সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে নিয়ে পারিবারিক শাসন কায়েম করেন শেখ হাসিনা। তাঁর চেয়ে বড় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ডা. মাহাথির মোহাম্মদ সে পথে হাঁটেননি। যদিও তাঁর সহধর্মিণী ডা. সিতি হাশমাহ বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ, রাষ্ট্রের আমলা সদস্য, সমাজসেবী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁকে ‘মাদার অব দ্য নেশন’ আখ্যায়িত করা হতো। ম্যাডাম হাশমাহ মাহাথিরের ভাইয়েরা ও অন্য আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রভাবশালী রাজনীতিকসহ উচ্চ পেশার লোকজন থাকলেও তাঁরা নিজেরা ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করেননি।

বাংলাদেশের পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে ডা. মাহাথির মোহাম্মদের মতো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়নের রূপকার ভাবার চেষ্টা করতেন। তেমন একটা ভাবও দেখাতেন। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের দেশপ্রেম, তাঁর দুর্নীতিমুক্ত জীবন-কালচার, তাঁর উন্নয়ন ভাবনার আধুনিক ধ্যান-ধারণা, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্বের ধারেকাছে যাওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেননি শেখ হাসিনা। কারণ ডা. মাহাথির আর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুরো বিপরীতমুখী। মাহাথির খাঁটি দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক আর তার বিপরীতে শেখ হাসিনা কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের দিকে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এ বাংলাদেশে একজন নেতা এসেছিলেন, যিনি মাহাথির মোহাম্মদের মতোই রাষ্ট্রনায়ক হতে পেরেছিলেন, তাঁর মতোই দেশপ্রেমিক, রাষ্ট্র-উন্নয়ন-ভাবনায় দক্ষ, গণমানুষের প্রকৃত স্বজন-জাতীয় নেতা হতে পেরেছিলেন তিনি জিয়াউর রহমান। যদিও মাহাথির ছিলেন একজন চিকিৎসাবিদ আর জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন জেনারেল, পেশাগতভাবে বিপরীত মেরুর মানুষ। কিন্তু দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তাভাবনায় তাঁরা ছিলেন খুবই কাছাকাছি। তাঁরা দুজনই রাষ্ট্রপরিচালনায় অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী ছিলেন। বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সফল রাষ্ট্রনায়ক।

দুর্ভাগ্য জিয়াউর রহমানের। এক অমুক্তিযোদ্ধা ক্ষমতালোভী জেনারেল ও তাঁর সহযোগীদের ষড়যন্ত্রে ৪৫ বছর বয়সেই তাঁকে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়। আর সৌভাগ্যবান ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, তিনি ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল অবধি তাঁর নব্বই-উত্তীর্ণ বয়সেও দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। ১০০ বছরের জীবনের ৭৫ বছর রাজনীতি করেছেন সুনামের সঙ্গে। ১৯৭৪ সাল থেকেই মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেছেন, তারপরে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ১৯৭৬ সালে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির প্রধান হয়ে বহু বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮১ সাল থেকেই তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন টানা ২২ বছর। ওই সময়ে দরিদ্র একটি রাষ্ট্রকে ব্যাপক দেশিবিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়নের দ্বারা উন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে নিয়ে যান। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে সে সুযোগ পাননি। মহান রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান যখন দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এই মুহূর্তে তাঁকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। জিয়াউর রহমান যদি কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ বছর আরও বাঁচতেন মোটামুটি শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নিয়ে, তাহলে তিনি তাঁর সততার রাজনীতি ও রাষ্ট্র-উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দিয়ে বাংলাদেশকে আজ মালয়েশিয়ার মতোই উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যেতে পারতেন। মালয়েশিয়া ছিল সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। ষাটের দশকেও মালয়েশিয়া থেকে ডাক্তারি পড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে আসতেন। পড়তেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মালয়েশিয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্ব পেলে বাংলাদেশও আজ সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯১ থেকে ’৯৬ এই পাঁচ বছরে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনি বাজার অর্থনীতির পথ ধরেন। গত তিন দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যতটুকু এগিয়েছে তা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের ফল। দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গণতন্ত্রের শত্রুরা থাবা বিস্তার করে নির্দয়ভাবে। তাদের ষড়যন্ত্রে ওয়ান-ইলেভেনের অপশাসন জাতির ঘাড়ে চেপে বসে। ২০০৮ সালে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূত্রপাত হয়, তার পেছনে ওয়ান-ইলেভেনের অপনায়কদের হাত ছিল ওপেন সিক্রেট। শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করতেন না বলেই ১৯১৪, ১৯১৮ ও ১৯২৪-এর মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন লুটপাটের মাধ্যমে। তাঁর আমলে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হতো, মেগা দুর্নীতি করার অভিলাসে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে মেনে নিতে পারেনি স্বাধীনতাবিরোধীরা। মেনে নিতে পারেনি গণতন্ত্রের শত্রুরা। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ দেশে বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। কেড়ে নিয়েছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। শহীদ জিয়া সে অধিকার ফিরিয়ে দেন। একদলীয় শাসনের বদলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করেন। দেশে গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক শাসন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার মতো উন্নয়নের সোপানে পা রাখার সুযোগ পেত।

মালয়েশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে প্রায় আড়াই গুণ। মাত্র ৩ কোটি ৫১ লাখ জনসংখ্যার দেশ। সংস্কৃতিগতভাবে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। উভয় দেশ ইসলামি আদর্শের অনুসারী হলেও মধ্যপন্থি উদারনৈতিক আধুনিক বিজ্ঞান-ভাবনার রাষ্ট্র। আফগানিস্তান-মার্কা উগ্র ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র নয়। দুদেশই যে ভবিষ্যতে সেদিকে পা বাড়াবে না, সেটা নিশ্চিত। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশই সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকারব্যবস্থায় পরিচালিত। মালয়েশিয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুর্নীতির বড় অভিযোগ জানা যায় না আর সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির প্রমাণও তেমন একটা পাওয়া যায় না।

মালয়েশিয়া ১৩টি স্টেট ও তিনটি বিশেষ অঞ্চল নিয়ে গঠিত। দেশটির আয়তন ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার। এর আগে কিছুকাল সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাই মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা আলাদা হয়ে গেছে অনেক বছর হলো। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ার নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করে ফেলে প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথিরের সরকার। বর্তমানে মালয়েশীয় নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১১ হাজার ৮৯২ মার্কিন ডলার (২০২৪ পরিসংখ্যান মতে)। দেশটির সাধারণ জিডিপি ৪৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থানে ৩৬তম)। আর পিপিপি জিডিপি গণনায় রাষ্ট্রটি বিশ্বে ৩০তম অর্থনীতির পর্যায়ে রয়েছে। আর সামগ্রিক সমৃদ্ধির সূচকে মালয়েশিয়া ৪৩তম অবস্থানে। বিশ্ব উদ্ভাবনমূলক সূচকে এ রাষ্ট্রটি ৩৩তম।

বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রের পথে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁদের উচিত হবে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে মালয়েশিয়া বা মাহাথির মডেল অনুসরণ করা। শহীদ জিয়ার মতো দেশপ্রেম ও সততার প্রতিফলন থাকতে হবে দেশ পরিচালনার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews