জড়বাদী চার্বাক দর্শনের এই কথাটি বেশ প্রচলিত যে ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। যার অর্থ, ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। এই দর্শনে ধার করে ঘি খাওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা বেশ বিপজ্জনক। করোনা মহামারির মধ্যে তো আরও বেশি। বিশ্বজুড়েই সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় ধার করে ঘি খেলে ‘শিরে সংক্রান্তি’ প্রবাদের কথা মনে হয়ে যেতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ের দিকে মানুষের ঝোঁক বেশি দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে স্থানীয় জরিপে দেখা গেছে, মানুষ এখন সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী বেশি। নতুন করোনাভাইরাস প্রথম মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল চীনে। পিপলস ব্যাংক অব চায়নার করা জরিপে দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় প্রবৃত্তিতে ব্রতী হয়েছেন। এটা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের চিত্র। চীনের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিপ বলছে, গত জুন পর্যন্ত এমন প্রবণতা বহাল ছিল। এখনো প্রায় ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, সঞ্চয় করাই বেশি প্রয়োজন।

কিন্তু বললেই তো আর টাকা-কড়ি জমতে শুরু করে না। এর জন্য পরিকল্পনা দরকার। তার চেয়েও বেশি দরকার সংকল্প। সঞ্চয় করবেন, সেই মানসিকতা আগে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সঞ্চয় কেন দরকার, সেই মৌলিক প্রশ্নে আর না যাই। এই মহামারিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা বুঝে গেছেন যে ট্যাঁকে কড়ি না থাকলে কী হয়! বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সাধারণত একজন উপার্জনক্ষম মানুষের ন্যূনতম ছয় মাস চলার মতো অর্থের তহবিল জমা থাকা উচিত। আপদে-বিপদে এটি স্বস্তি দেয়। তবে কেউ যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হন বা পেশায় ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন, তবে তহবিল প্রয়োজন ন্যূনতম ১২ মাসের। এতে হুট করে বিপদ এলে দিশেহারা হতে হয় না।

আসুন, এই করোনাকালে সঞ্চয় কীভাবে বাড়াবেন, তার সুলুক সন্ধান করা যাক:

১. প্রথমেই আয়-ব্যয় লিখে রাখার অভ্যাস করুন। যদি ১০ টাকা দিয়ে একটি কলমও কিনে থাকেন, সেটিও ব্যয়ের খাতায় তুলুন। এতে আপনার অর্থ ব্যয়ের পাগলা ঘোড়ার গতি কমে আসবে। আপনি বুঝতে পারবেন, কোন কোন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় করছেন। আবার আয়-ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্রও স্পষ্ট হবে। প্রতিটা ব্যয় লেখার সময়ই দেখতে পারবেন, কত আয়ের বিপরীতে ঠিক কতটা খরচ করছেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, আপনি তখন মাসের বাজেট নির্ধারণ করতে পারবেন, তাতে কাটছাঁটও করতে পারবেন। ২০১৩ সালে গ্যালাপের এক জরিপে দেখা গেছে, গৃহস্থালি বিষয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখে রাখেন প্রতি তিনজনে মাত্র একজন। অর্থাৎ খুব কম মানুষই নিজেদের আয়-ব্যয়ের প্রকৃত হিসাব রাখেন না। ফলে নিয়মিত সঞ্চয়ও হয় না।

২. লিখে রাখলেই বুঝে যাবেন, কোনো অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করছেন কি না। যেমন: আপনার হয়তো জিমে সদস্যপদ নেওয়া আছে। কিন্তু করোনাকালে কি সেখানে যাওয়া হচ্ছে? অথবা একাধিক স্ট্রিমিং কোম্পানির সেবা নিতে হয়তো সাবস্ক্রিপশন নিয়েছেন, কিন্তু সবগুলোই কি কাজে লাগছে? ব্যয়ের এসব অতিরিক্ত খাত চিহ্নিত করুন। প্রয়োজন না থাকলে বাদ দিয়ে দিন। যে অর্থ বাঁচবে, তা সহজেই সঞ্চয় করতে পারবেন।

৩. প্রতি মাসে খাবারের পেছনে প্রায় সব পরিবারেরই বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ খরচ হয়। ভেবে দেখুন, আগে বাইরে খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক কী পরিমাণ খরচ করতেন? এখনো কি তা–ই করছেন? যদি কম করে থাকেন, তবে বাকি অর্থ কোথায় যাচ্ছে? সেটিকেও সঞ্চয়ের ঘরে ঠেলে দিন। আবার সারা মাসের খাবার খরচের ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবার কেনায় নজর দিন। ৫ কেজি ডালে যদি মাস চলে তবে ১০ কেজি কিনবেন কেন? এর চেয়ে ওই অর্থ জমাতে পারেন।

৪. বর্তমান যুগে ধার করে ঘি খাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার ক্রেডিট কার্ড। মাঝেমধ্যে সংগতি না থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় এটি আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয় বটে। তবে মহামারির সংকটের সময় এতে জমা হওয়া দেনা বোঝা হিসেবে দেখা দিতে পারে। দিশেহারা না হয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু একটু করে ক্রেডিট কার্ডের দেন শোধ করা শুরু করুন। একসময় দেনা শোধ হলে দেখবেন মাস শেষে কিছু বাড়তি অর্থ হাতে থাকছে। সেটি সঞ্চয় করা শুরু করুন। এতে নিজের কড়িতেই ঘি কিনে খেতে পারবেন।

৫. মাসের বড় বড় খরচ নিয়ে ভাবতে শুরু করুন। যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁদের জন্য বাড়ির ভাড়া একটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যয়। কিন্তু একটু কম ভাড়ার বাড়িতে কি দিন গুজরান করা যায়? এমনটা ভেবে দেখতে পারেন। এতে হয়তো সুবিধা কিছুটা কম পেলেও বেশ বড় অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় করার পথ পেয়ে যেতে পারেন। এভাবে খরচের প্রতিটি খাত থেকেই কিছু অর্থ বাঁচাতে পারেন। মনে রাখবেন, সংকটের দিনে টিকে থাকাই বড় কথা।

৬. এতক্ষণ খরচ কমিয়ে টাকা সঞ্চয়ের নানা ফন্দি-ফিকির নিয়ে আলোচনা হলো। কিন্তু টাকা জমাবেন কোথায় এবং কখন? মনে করুন, আপনি যেহেতু আয় করছেন, সুতরাং নিজেকে পুরস্কৃত করাটা অতীব প্রয়োজন। মাসের শুরুতেই সঞ্চয়ের অর্থ আলাদা করে ফেলুন। ভেবে নিন, এটি নিজেকে দেওয়া উপহার, যা পরবর্তী সময়ে আপনাকে জীবনযুদ্ধে টিকিয়ে রাখবে। এটিকে অভ্যাসে পরিণত করুন।

৭. অর্থ কোথায় সঞ্চয় করবেন, তা নিয়েও ভাবুন, কৌশলী হোন। যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয়ে একটু বেশি আর্থিক সুবিধা পাবেন, সেখানে জমা রাখাই উত্তম। তবে বেশি সুদ পাওয়ার লোভে প্রচলিত আইন অনুমোদিত নয়, এমন কোথাও সঞ্চয় করবেন না। জেনে-বুঝে নিন। তা না হলে শেষে আম ও ছালা দুই-ই যাবে।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, সিএনবিসি, ব্যাংক অব আমেরিকা ডট কম, জাপান টাইমস ও দ্য ব্যালান্স ডট কম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews