শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার আলোচনায় বোয়িংয়ের কাছ থেকে উড়োজাহাজ কেনার বিষয়টি ‘একবারও’ আলোচনায় আসেনি বলে দাবি করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
তিনি বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় আমার কাছে মনে হয়নি যে, তারা বোয়িং কেনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এটা একবারের জন্যও আলোচনায় আসেনি।
“বরং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল কৃষিপণ্য নিয়ে। বাংলাদেশ প্রতিবছর দেড় থেকে দুই হাজার কোটি ডলারের খাদ্যপণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশ যদি ন্যয্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পারে, তাহলে ভোক্তারাও উপকৃত হবে; বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।’’
যুক্তরাষ্ট্র যে চুক্তিতে বাংলাদেশি পণ্যের সম্পূরক শুল্কে ছাড় দিয়েছে, তা ওয়াশিংটনের ‘সম্মতি স্বাপেক্ষে’ প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
তিনি দাবি করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যে চুক্তি, তাতে দেশের ‘স্বার্থবিরোধী’ কিছু নেই। যেগুলো স্বার্থবিরোধী মনে হয়েছে, সেগুলো থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল সরে এসেছে।
শুল্ক বিষয়ে দুই দেশের মধ্যকার ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টকে’ (এনডিএ) নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনার মধ্যে শনিবার এ অবস্থান তুলে ধরলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
এদিন শেখ বশিরউদ্দীনের একটি সাক্ষাৎকার নিজের ফেইসবুক পেইজে প্রকাশ করেন ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (প্রেস উইং) গোলাম মোর্তোজা।
সেখানে উপদেষ্টা বলেন, ‘‘চুক্তি সই হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি স্বাপেক্ষে তা প্রকাশ করা হবে। চুক্তি হওয়ার পর শিগগিরই হয়ত যৌথ বিবৃতি আসবে। তথ্য অধিকারের আলোকে এটা করা হবে।’’
“বাণিজ্য একটি গতিশীল বিষয়। হোয়াইট হাউসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে। এটার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করবে আমাদের বাণিজ্যিক সক্ষমতার ওপর। এ থেকে ফল পেতে গেলে নিজস্ব সক্ষমতা ও প্রতিযোগিশীলতা লাগবে।’’
শুল্কে ছাড় এলেও ‘আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই’ বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
চুক্তির গোপনীয়তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি আন্তর্জাতিক রীতিতেও নির্দিষ্ট, শুধু তাই নয়, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বা বীমা চুক্তিতেও গোপনীয়তার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক।
‘‘এমনকি দুজন ব্যক্তি সম্পদ হস্তান্তর করলেও এ ধরনের বিষয় থাকে, তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বলে যে, আপনি কাউকে বলবেন না।’’
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘‘কারণ হতে পারে, আপনার প্রতিবেশি জেনে যেতে পারে, সমস্যা তৈরি করতে পারে, বা অন্য কেউ এখানে এসে দাবি করতে পারে।’’
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের ঘাড়ে পড়ে ৩৫ শতাংশ।
পরে দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্তও আছে।
দুই দেশের প্রতিনিধি দলের কয়েক দফা বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।
এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যকার নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টকে (এনডিএ) ‘খুবই স্বাভাবিক বিষয়’ মন্তব্য করে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র মূলত যেটার বিনিময়ে চুক্তিটি করেছে, তা হলো তারা তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটিকে ব্যবহার করেছে। চুক্তির মূল নিয়ামক হিসেবে নিজস্ব নিরাপত্তার কথা বলেছে, সেখানে আলোচনায় গোপনীয়তার শর্ত থাকা অবশ্যম্ভাবী। এর মাধ্যমে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো উপাদান থাকলে আমরা সে চুক্তিতে উপনীত হব না, সেটাই তো স্বাভাবিক।
‘‘আমাদের নিজস্ব স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। নিজস্ব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলে সক্ষমতার ঘাটতি হবে। তাতে আমাদের বাণিজ্য চুক্তি করে লাভ হবে না। স্বল্প মেয়াদে বা দীর্ঘ মেয়াদে যদি আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতা হ্রাস পায় বা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির কোনো ধরনের ক্ষতি হয়, সেই চুক্তি কোনোভাবেই পালনযোগ্য নয়।’’
দেশের স্বার্থ বিসর্জনের ‘কোনো সুযোগই নেই’ মন্তব্য করে বশিরউদ্দীন বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, চুক্তিটি সই হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের জয়েন্ট সেস্টমেন্ট হয়ত শিগগিরই আসবে। তারপরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি স্বাপেক্ষে চুক্তিটি প্রকাশ করব।’’
আলোচনা চলাকালে ‘দুঃখজনকভাবে’ চুক্তিটি লিক(ফাঁস) হয়ে গিয়েছিল জানিয়ে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘‘সেখানে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু নেই। যেগুলো দেশের স্বার্থবিরোধী ইনডাইরেক্টলি হতে পারে, সেসব জিনিস থেকে ক্লিয়ারলি বের হয়ে এসেছি।’’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ তুলে ধরতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের একটা দল এখানে (ওয়াশিংটনে) এসেছে। ব্যক্তিখাতের ব্যবসায়ীরা মূল্য নিয়ে প্রতিযোগিতা না করতে পারলে তো নিবে না, ব্যবসা করবে না।’’
বাংলাদেশ মূলত জ্বালানি ও কৃষিপণ্যের ভিত্তিতে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ৬০০ কোটি ডলারের মতো। ফলে বাংলাদেশে তুলা, সয়াবিন, ভুট্টা, গমজাতীয় পণ্য আমদানি বাড়িয়ে ২০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যঘাটতি কমানোর তাৎপর্যর্পূণ চেষ্টা করতে পারে।’’
আরও পড়ুন
ট্রাম্পের শুল্ক: বিপদ আসতে পারে আগামীতেও, 'শিক্ষা' নেওয়ার পরামর্শ
বাংলাদেশি পণ্যে ২০% সম্পূরক শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের