নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বয়ারচরের কৃষক আব্দুল মোমেন ২৫ বছর ধরে কৃষিকাজ করেন। ১০ একর জমিতে ধান, সরিষা, তরমুজ ইত্যাদি আবাদ করে তাঁর সংসার চলে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জমিতে সার প্রয়োগ করলেও কখনও মাটি পরীক্ষা করাননি। মাটির স্বাস্থ্য নিয়েও তাঁর নেই কোনো ধারণা। কোথায় মাটি পরীক্ষা করতে হবে, তাও জানা নেই। শুধু আব্দুল মোমেন নন, দেশের অধিকাংশ কৃষক মাটির বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না। গত কয়েক দিনে দেশের পাঁচ জেলার ১০৩ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র মিলেছে। ১০৩ জনের মধ্যে চারজন কৃষক মাটি পরীক্ষা করে চাষাবাদ করেন। ২৫ জন মাটি পরীক্ষার বিষয়টি জানলেও কোথায় পরীক্ষা হয়, তা জানেন না। অন্যরা মাটি পরীক্ষার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সুযোগ রয়েছে মাটি পরীক্ষার। কৃষকরা জানান, এ বিষয়ে প্রচার না থাকা ও মাঠ পর্যায়ে সরকারি কার্যক্রমের স্থবিরতার কারণে তাঁরা সুবিধা পাচ্ছেন না। গত কয়েক বছরে এ ইনস্টিটিউটের বড় কোনো গবেষণাও নেই। নেই কোনো উদ্ভাবন। অনেকটা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এটি।
কৃষক জমিতে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন মাত্রাতিরিক্তি। সচেতনতার অভাবে মাটির ওপরের অংশ বিক্রি করে দিচ্ছেন ইটভাটায়। চলতি বছর এসআরডিআইর এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০০০ সালে দেশে উর্বরতার ঘাটতি আছে- এমন জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর। ২০২০ সালের মধ্যে উর্বরতা বা পুষ্টি ঘাটতি আছে এমন ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ১১ লাখ হেক্টরে।
এ পরিস্থিতিতে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য 'মাটি :খাদ্যের সূচনা যেখানে'। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর ফার্মগেটে কেআইবি মিলনায়তনে সেমিনার, সয়েল কেয়ার অ্যাওয়ার্ড ও বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এতে প্রধান অতিথি থাকবেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের দুটি উইং, দুটি বিভাগ, প্রশাসন, কার্টোগ্রাফি, ডাটা প্রসেসিং অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকেল অ্যান্ড আইসিটি এবং পাবলিকেশন অ্যান্ড রেকর্ড শাখাসহ ৯টি শাখা রয়েছে। সাতটি বিভাগীয় কার্যালয়, ৩৩টি আঞ্চলিক কার্যালয়, সাতটি বিভাগীয় গবেষণাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার এবং দুটি গবেষণা কেন্দ্র আছে। এ ছাড়া সরেজমিন মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের সুপারিশ করার লক্ষ্যে ১০টি ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষাগার রয়েছে। কিন্তু এর সুফল পাচ্ছেন না কৃষক।
ফেনীর সোনাগাজীর কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাটি পরীক্ষার বিষয়ে তাঁর এলাকার কৃষকরা কখনোই শোনেননি। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেশে আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৮৫ শতাংশের উর্বরাশক্তি কমে গেছে। জৈব পদার্থের অভাব রয়েছে, এমন জমির পরিমাণও ৩৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, এমন প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রত্যেক কৃষককে এখন পর্যন্ত সম্প্রসারণ কর্মীরা দিতে পারেননি। কৃষক মনে করছেন, বেশি সার দিলে উৎপাদন বেশি হবে। সরকারের কার্যকর নীতি ও সম্প্রসারণ কর্মীরা সক্রিয় না হলে এই প্রবণতা বন্ধ হবে না।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. কামারুজ্জামান বলেন, তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে ফসল উৎপাদন সম্পর্কে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গাইড তৈরি করেন। ভ্রাম্যমাণ গবেষণা কেন্দ্রে কৃষকদের সরবরাহ করা মাটি পরীক্ষা করা হয়। কৃষকদের সচেতন করতে মাঠ দিবস, সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে।
কিন্তু জনবল সংকটের কারণে সব কৃষককে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।