জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যে মানুষটা বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে থাকেন, তিনি বাবা। নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করে আলোকিত করতে চান সন্তানকে। যাদের বাবা নেই, তারা জানেন—কত বড় একটি ছায়া থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু সন্তানরা অনেক সময় বাবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে পারেন না। হৃদয়ের কোনায় জমা থাকে ভালোবাসার না বলা কথাগুলো। বাবা দিবসে সেই অপ্রকাশিত ভালোবাসার কিছু কথা তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা।

বাবা, তোমার মতো হতে চাই
মুজাহিদ ইসলাম জীবন, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ছোটবেলায় বাবাকে বুঝে উঠতে পারিনি। মনে হতো, কেন তিনি সবকিছুতে বারণ করেন, কেন এত পরামর্শ? “এভাবে চল”, “এটা করিস না”, “ওটা কর” এইসব কথায় বিরক্তি আসত। এখন বুঝি, সেসব কথাই ছিল আমার জীবনের গাইডলাইন। “বাবা” শুধু একটি শব্দ নয়, এর ভিতর লুকিয়ে আছে পুরো একটা জীবন। ছোট্ট হাত ধরে হাঁটতে শেখানো মানুষটা আজও নিঃশব্দে পথ দেখান, কখনো শাসনের মুখোশে, কখনো ভালোবাসার নিঃশব্দ ভাষায়।

আমরা বড় হই, ভুল করি, ভেঙে পড়ি, আর তিনি চুপচাপ পাশে থাকেন। না বলা অনেক কথায়, না কাঁদা চোখের জলেই বুঝিয়ে দেন, “আমি আছি, ভয় পাস না!”

বিশ্ব বাবা দিবস আজ। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল ‘বাবা’ নামক মহাপুরুষরা। এ রকম হাজারও কথা বলা যাবে বাবাকে নিয়ে, তবুও শেষ হবে না সন্তানের প্রতি, সংসারের প্রতি তাঁর অবদানের কাহিনি।

বাবা শাশ্বত, চিরন্তন। আর বাবার তুলনা বাবা নিজেই। আমরা সন্তানেরা সবসময় মুখ ফুটে বলতে পারি না “ভালোবাসি বাবা।”
তবুও প্রতিটি আচরণে, প্রতিটি শূন্যতা পূরণে, প্রতিটি না বলা অনুভবে তুমি আমাদের পুরো পৃথিবী। আজ আমি শুধু বলতে চাই, “বাবা, তুমি মানুষ হিসেবেই অসাধারণ। তোমার মতো হতে না পারি, কিন্তু তোমার মতো হতে চাই।”

বাবা, তুমি আমার অস্তিত্ব
সেজু আক্তার, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনে তার বাবা সুপারহিরো। আমার জীবনেও বাবা সবচেয়ে বড় আশ্রয় ও ভরসার কেন্দ্র। তিনি আমার পরিবারের অভিভাবকই নয়, তিনি আমার প্রথম শিক্ষক ও বন্ধু। তাই বাবাকে নিয়ে আমার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো কখনো শেষ হওয়ার নয়।

মা ও দাদুর মুখ থেকে শুনে এসেছি, ছোটবেলায় আমি অনেক কান্না করতাম, তখন বাবা সারারাত আমায় কোলে নিয়ে বাইরে হাঁটতেন।
যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি আমার বাবাকে। একটা মানুষ কতটা বিনয়ী, আত্মত্যাগী আমি আমার বাবার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। প্রতিটি মেয়ের জীবনেই তার বাবা এমন, কিন্তু আমার বাবা আমার জন্য অনেক বেশি স্পেশালএখন যদিও আমাদের যোগাযোগটা অনেকটাই মুঠোফোনে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর ভালোবাসা কোনো অংশেই কমেনি।

এই তো সেদিন ঢাকায় আসব— তিনি বাসস্টেশন পর্যন্ত নিয়ে এলেন। আমি বললাম, “এবার তুমি চলে যাও, আমি যেতে পারব তো।” কিন্তু তিনি গেলেন না। বাস ছেড়ে দিল, আমি পিছনে ফিরে বারবার দেখছিলাম, দেখছিলাম আমার মধ্যবয়স্ক সাহসী সংগ্রামী বাবাকে। হয়তো তিনি জানতেও পারেননি, তাঁর মেয়ের কতটা খারাপ লাগা কাজ করছে।

ভালোবাসি অনেক তোমায়। বাবা দিবসে একটাই চাওয়া, ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা।

বাবা কখনো বৃদ্ধ হয় না
অর্ণব দাশ, শিক্ষার্থী, চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

যে মানুষটার প্রতিদিনের পরিশ্রমে আমাদের ভালো রাখার গল্প লিখিত হয়, সেই মানুষটা বাবা আর মা তাঁর সহযোগী।
সবসময় মনে হতো, বাবা মানে ভয় দিয়ে মোড়ানো একটা বাসা। শাসনের বেড়াজালে ছেলেরা বাবাকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। আমিও তার ব্যতিক্রম না।

আমার পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই বাবা সবচেয়ে বেশি তদারকি করতেন। ছাতা হয়ে যে মানুষটা আমাদের আগলে রাখেন, তাঁর কথা মনে করার জন্য কেবল একটা দিন যথেষ্ট নয়, বরং প্রতিটা দিনই বাবা দিবস।

আমরা যারা পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে অবস্থান করছি, আমরাই হয়তো সবচেয়ে বেশি এই জিনিসটা ফিল করি।
হাজারো ক্লান্তি শেষে মুখে খুব বেশি কিছু বলা হয়তো হয়ে উঠে না, তবে বাবার চোখের পাতায় আর ক্লান্ত হাসিতে আমি যেন সব কথা বুঝে যাই।

মুখ ফুটে হয়তো কখনো বলা হয়ে উঠবে না ঠিক কতটা ভালোবাসি বাবা। তবে তোমার সেই ছোট্ট অর্ণব তোমায় অনেক ভালোবাসে।
জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পী জেমসের গানের লাইন দিয়ে যদি শেষ করি তবে, “ছেলে আমার বড় হবে, মাকে বলত সে কথা। হবে মানুষের মত মানুষ, এক লেখা ইতিহাসের পাতায়।”

এমন গানের প্রতিটা লাইনের মতোই আমার/আমাদের বাবারা স্বপ্ন দেখেন—একদিন তাঁর সন্তান ইতিহাস সমান কিছু হবে। বিশ্ব বাবা দিবসের শুভেচ্ছা নিও। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা।

আব্বু—তুমিই আমার সব
নুসরাত জাহান অর্পিতা, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

"আব্বু" এই শব্দটাই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ডাক। সবাই ব্যথা পেলে আম্মুকে ডাকে। আর আমি সুখে, দুঃখে, ভয় আর অনিশ্চয়তায় সবসময় একজনকেই ডাকি, তিনি আমার আব্বু।
আব্বুর সাথে ঘনিষ্ঠতা আমার ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা থেকেই আব্বুর পেছনে পড়ে থাকার স্বভাব।
আব্বু খাইয়ে না দিলে খেতাম না, আব্বু না আসা পর্যন্ত ঘুমাতাম না। ঢাকায় এলেই সবচেয়ে বেশি মিস করি আব্বুকে।
যখন এলার্জির কারণে হাত দিয়ে ভাত খেতে গিয়ে চোখে পানি পড়ে, তখন খুব মনে পড়ে—বাড়ি থাকলে তুমিই তো খাইয়ে দিতে।

এই টানটা শুধু আবেগের কারণে নয়, পারিবারিক কিছু কারণও আছে যার জন্য আব্বুর সাথে এর গভীরতা বেশি হয়েছে।
আমি ছোট থেকে দেখে এসেছি তোমার অক্লান্ত পরিশ্রম, নিঃশব্দ আত্মত্যাগ। জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনেক ভুল করেছি। কিন্তু তুমি সবসময় পাশে থেকেছ বন্ধুর মতো।

আমার ছোট ছোট প্রাপ্তিতে সবথেকে বেশি তুমিই খুশি হও। তুমিই আমার নির্ভরতার জায়গা। তুমি শুধু আমার বাবা নও, তুমি আমার অনুপ্রেরণা, আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর অনুভব।

ভালোবাসি আব্বু। চিরকাল তোমায় ভালোবাসবো।

বাবার আরেক নাম অনুপ্রেরণা
হুমায়ুন আহমেদ নাইম, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বাবা শুধু একজন অভিভাবক নন, তিনি আমার নির্ভরতার প্রতীক, জীবনের প্রতিটি বাঁকে সাহস জোগানোর বটগাছ।
ছোটবেলায় হাত ধরে হাঁটা শেখানো সেই মানুষটিই জীবনের পথে চলার শক্তি হয়ে দাঁড়ান।
তাঁর কঠোর পরিশ্রম, নীরব ত্যাগ আর দায়িত্বশীলতা আমাদের শিখিয়ে দেয় কীভাবে জীবনের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
হাজার পরিশ্রমে যদিও ঘামে তাঁর শার্ট ভিজে যায়, তবুও তাঁর চোখে কখনো ক্লান্তি দেখি না।
পরিবারের সামনে তিনি সবসময়ই পাহাড়ের মতো দৃঢ়।
তাঁর বিশ্বাস আর সাহসিকতা আমাদের জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকা নিঃশব্দ অনুপ্রেরণা।
ঢাকায় একা একা যখনই বিপদে পড়ি, তখনই বাবার দেওয়া শিক্ষা আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
বাবা মানেই নিরব ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
সত্যি বলতে, বাবাই আমার একমাত্র অনুপ্রেরণা।

বাবা, তুমিই আমার একমাত্র সাহস
শায়লা ইসলাম, শিক্ষার্থী, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

আমার বাবা যেন বটবৃক্ষ। তিনি যেন প্রতিনিয়ত অক্সিজেন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখছেন।
আমাকে সর্বদা ছায়া দিয়ে, তাঁর বিশাল বিশাল ডালপালা দিয়ে সকল প্রকার ঝড়-ঝাপটা থেকে রক্ষা করে আসছেন।
আমি যতবার হেরে গেছি, আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন জীবনে হারতে হয়।
আমার হাতে খড়ি, ছেলে ভুলানো গল্প অথবা "জনি জনি ইয়েস পাপা" কবিতাটাও বাবার কাছ থেকেই শুনে বড় হওয়া!
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, বড় হতে হতে যেন এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল আমাদের মাঝে।
একটা নিঃশব্দ বেড়াজাল গড়ে উঠল, যেখানে অনুভূতির ভাষা হারিয়ে যেতে লাগল একে একে।
অদৃশ্য কিছু একটা অনুভুতি প্রকাশকে নিশ্চুপ করে দিতে থাকল।
এতটুকু খুশি হয়েই বলতে ইচ্ছে করে, “বাবা, আমি পেরেছি।”
অথবা সেই যে বাড়ি এসেই বলতেন, “আমার মা কোথায়?” এই দুটি শব্দই হারিয়ে গেল।
আমরা অনুভূতি প্রকাশে ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেলাম!
কোথাও একটা বেড়াজালের সৃষ্টি হলো, সেখানে যেন অনুভুতি প্রকাশ করা মানা।
বাবা, ভালোবাসি তোমাকে, না বলেও অনেক ভালোবাসি।
প্রতিবার সফলতা অথবা ব্যর্থতায় তোমাকেই মনে করি।
জানি, আমার সকল অবস্থায় তুমিই আমার একমাত্র সাহস, আমার শক্তি, আমার বাবা।