আগামীতে কমে আসবে মূল্যস্ফীতি, বাড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর-জিডিপির অনুপাত, এমনকি বেসরকারি বিনিয়োগও। কর্মসংস্থানও বাড়বে। রাজস্ব আদায়ে উচ্চ আদায়ে অগ্রগতি হবে। এ রকম আশাবাদ ব্যক্ত করেই আগামী অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি বাজেট জাতির সামনে উত্থাপন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গতকাল বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে অর্থ উপদেষ্টা এই আশাবাদ ব্যক্ত করে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটটি ঘোষণা করেন। তবে তার এই আশাবাদ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কৌশলের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি বাজেট বক্তৃতায় তথ্য-উপাত্তেরও ঘাটতিও চোখে পড়ার মতো ছিল। যেমন- বিগত বাজেট বক্তৃতায় দেখায় সেখানে জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, বেসকারি বিনিয়োগ, কর-জিডিপির অনুপাতের একটি প্রক্ষেপণ ছিল। কিন্তু এবারকার বাজেট বক্তব্যে তা অনুপস্থিত। এগুলোকে খুঁজে বের করতে হলে যেতে হবে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে। এখানে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ হবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি অর্জন কিভাবে হবে তার কোনো কৌশলও সেভাবে বলা হয়নি। এমনকি এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে দেশে কী পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে তার কোনো তথ্য উপাত্ত বাজেট বত্তৃতায় পাওয়া যায়নি।
একই অবস্থা মূল্যস্ফীতির বেলায়, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এটিকে আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেট উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটি অর্জন করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হবে তার উল্লেখও বাজেটে নেই। কিন্তু বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং কমবে মূল্যস্ফীতি। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।’
বাজেটে আকার কমছে : এবারকার বাজেটের আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে তা সাত হাজার কোটি টাকা কম। চলতি বাজেটের আকার রয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এবারকার বাজেট আকার জিডিপির অংশ হিসেবে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এক সময়ে এই হার ছিল ১৮ শতাংশ। অবশ্য অর্থ উপদেষ্টা নিজেই তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে।’
সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বাড়ছে, বরাদ্দ জুলাই যোদ্ধাদের জন্য : সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর চলমান বিভিন্ন কর্মসূচির সুবিধাভোগী ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, দরিদ্র, প্রান্তিক ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাস, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবারের বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং মাথাপিছু বরাদ্দ- দুটিই বৃদ্ধি করার দিকে নজর দেয়া হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছর থেকে বেশ কিছু ভাতার হার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বয়স্ক ভাতার মাসিক হার ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলাদের মাসিক ভাতা ৫৫০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকায়, প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৮৫০ টাকা হতে ৯০০ টাকায় এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রদত্ত মাসিক ভাতার হার ৮০০ টাকা হতে ৮৫০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন। এ ছাড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মাসিক ভাতার হার ৬৫০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচির ভাতার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি যৌক্তিক পরিমাণে উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে। আগামী অর্থবছরে বয়স্কভাতার সুবিধাভোগী ৯৯ হাজার জন বাড়ানো হবে। বিধবা ও স্বামীনিগৃহীত মহিলা সুবিধাভোগী বাড়ানো হবে ১ লাখ ২৫ হাজার জন। প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষাবৃত্তির সুবিধাভোগী বাড়ানো হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার জন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী খাতে সুবিধাভোগী বাড়ানো হবে ৯৪ হাজার জন। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সুবিধাভোগী বাড়বে ২ লাখ। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী বাড়বে ১ লাখ ১৬ হাজার জন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সুবিধাভোগী বাড়বে ২ লাখ জন। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের উপবৃত্তির সুবিধাভোগী বাড়বে ৯ লাখ ৯০ হাজার জন।
এ ছাড়া সরকার বর্তমানের তুলনায় ১১ লাখ ৪৭ হাজার ব্যক্তিকে ওএমএস সুবিধা বেশি দেয়ার প্রক্ষেপণ করেছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে ৩ লাখ ৩৭ হাজার জনকে নতুন করে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা নিয়েছে। আর আগামী অর্থবছরে ৫০ হাজার মানুষ পেনশন সুবিধা পাবেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সঠিক ব্যক্তি যাতে উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত হন সে লক্ষ্যে ডায়নামিক সোশ্যাল রেজিস্ট্রি (ডিএসআর) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে পেনশন বাবদ থাকছে ৩৫ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পেনশন ব্যতীত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। তবে আগামী অর্থবছরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদে সরকার যে প্রিমিয়াম দেয়, সেটি বাদ দেয়া হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহতদের সহায়তা : আগামী অর্থবছরের বাজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ১৫ হাজার ব্যক্তি এই সুবিধা পাবেন। তবে কে কীভাবে সুবিধা পাবেন সেটি বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেননি ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেছেন, শিগগিরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ, গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার এবং আহত ছাত্র-জনতার পুনর্বাসনসহ গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ ও চেতনাকে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য ভাতা, চিকিৎসা, অনুদান ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়।
মধ্যবিত্তদের খরচ খানিকটা বাড়বে : আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেশে মোবাইল উৎপাদন ও সংযোজনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো হয়েছে এবং মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কমানোয় মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।
ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার : ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, আয়রন, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো হয়েছে।
প্লাস্টিকের তৈজসপত্র, এলপিজি সিলিন্ডার, বিদেশী চকলেট, লিপস্টিক, ব্লেড-এর ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে
তবে বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে স্থানীয় ঋণপত্রের কমিশনের উৎসে কর কমিয়ে অর্ধেক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তিও পাবেন। বর্তমানে বেশ কিছু পণ্যে ১ শতাংশ উৎসে কর রয়েছে যেটি নতুন বাজেটে ০.৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করে দাম কমে যাবে- ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, খেজুর, ক্যাসিয়া পাতা এবং সব ধরনের ফলের। এসব পণ্যের ক্রেতা সাধারণ মানুষের জন্য এ পদক্ষেপ স্বস্তির হবে। একই সাথে চিনি, আইসক্রিম, বিদেশী মাছ ও কাপড়ের ওপরও শুল্ক কমানো হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম কমবে।
উপদেষ্টা পরিষদে বাজেট অনুমোদন : গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে আগামী অর্থবছরের বাজেটটি অনুমোদন করিয়ে নেন অর্থ উপদেষ্টা। সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে (অনুদানসহ- দুই লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে বড় একটি অঙ্ক পূরণ করা হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ আসবে ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বিদেশী ঋণ সহায়তা ধরা হয়েছে নিট ৯৬ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে করসমূহ থেকে আসবে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথ প্রশস্ত হবে এবারের বাজেট বাস্তবায়নে। পাশাপাশি, রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটা যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়নও এ বাজেটের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।