ছবির উৎস, Getty Images
৮ মিনিট আগে
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরের পাটাপস্কো নদীতে সেতু ধসের পর পানির প্রায় ২৫ ফুট নীচে ডুবে যাওয়া একটি ট্রাক থেকে দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছেন ডুবুরিরা।
এর আগে মঙ্গলবার বাল্টিমোর শহরের কাছে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ ফ্রান্সিস স্কট কি সেতুতে আঘাত করলে সেতুটি ভেঙ্গে নদীতে পড়ে। ওই ঘটনায় সেসময় বহু যানবাহন পাটাপস্কো নদীতে পড়ে যায়।
সেখানেই পানিতে ডুবে যাওয়া একটি লাল রঙয়ের পিকআপ ট্রাক থেকে ওই দু’টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
জাহাজটি যখন সেতুতে ধাক্কা দেয়, তখন সেখানে আটজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন, যারা সবাই তখন পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলেন।
ঘটনার দিন দুইজনকে উদ্ধার করা হয় এবং বাকিদের সন্ধান চলতে থাকে। যদিও উদ্ধারকর্মীদের আশংকা তারা পানিতে ডুবে মারা গেছেন।
বুধবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে মেরিল্যান্ড স্টেট পুলিশ জানিয়েছে, ট্রাকের মাঝ থেকে উদ্ধার হওয়া নিহত দুইজনের একজন মেক্সিকোর নাগরিক এবং অপরজন গুয়াতেমালার নাগরিক।
মূলত, সেদিন জাহাজের সেতুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার ঘটনায় সেতুর মাঝের অংশ ভেঙ্গে গিয়ে ধসে পড়ে এবং সেতুর ওপর থাকা অনেক মানুষ ও গাড়ি নদীতে পড়ে যায়।
সেতু ধসে পড়ার সময় যে আটজন নির্মাণ শ্রমিক সেতুর কাঠামোর সঙ্গে পাটাপস্কো নদীর হিমশীতল পানিতে ডুবে গিয়েছিলেন, সেদিনই সেখান থেকে দু’জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বুধবার রাতে পুলিশ জানায় যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বাকী ছয়জনের দু’জনের মরদেহ আজ উদ্ধার হলো। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সবাই-ই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। কারণ নদীর ঠাণ্ডা পানিতে এত দীর্ঘসময় ধরে টিকে থাকা অসম্ভব।
পুলিশ জানিয়েছে, নদীতে এখন কংক্রিট ও সেতুর ধ্বংসাবশেষ থাকায় ডুবুরিরা আর পানিতে নিরাপদে চলাচল করতে পারছে না।
তাই, তারা এখন সোনার স্ক্যান বা শব্দ সংকেত ব্যবহার করছেন। তারা মনে করছেন, সেতু ধসের সময় যে গাড়িগুলো নদীতে পড়ে গিয়েছিলো, সেগুলো সেতুর এই “সুপারস্ট্রাকচার এবং কংক্রিটে আবদ্ধ” রয়েছে।
ছবির উৎস, REUTERS
ছবির ক্যাপশান,
দ্য বাল্টিমোর ব্রিজ, সহজভাবে যার পরিচিত হলো দ্য কি ব্রিজ নামে
আপাতত তারা এখন পানির নীচে থাকা সেতুর ধ্বংসাবশেষ সরানোর দিকে আলোকপাত করছে, যাতে করে ডুবুরিরা অবিলম্বে বাকী নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করতে পারে।
সেতু ধসে নিহত ছয় জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা দক্ষিণ আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর এবং হন্ডুরাসের নাগরিক।
এর আগে মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিলো, তাদের দু’জন নাগরিক এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সেই দু’জনের একজন হলেন ট্রাক থেকে উদ্ধার হওয়া মি. ফুয়েন্তেস।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা টম পেরেজ বলেছেন, জো বাইডেন এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য শোক প্রকাশ করেছেন এবংদেশটির সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
ছবির উৎস, Reuters
ছবির ক্যাপশান,
যে কার্গো জাহাজটি বাল্টিমোর সেতুকে ধাক্কা দিয়েছিলো, তা থেকে একটি ডেটা রেকর্ডার খুঁজে পাওয়া গেছে।
এদিকে যে কার্গো জাহাজটি বাল্টিমোর সেতুকে ধাক্কা দিয়েছিলো, তা থেকে একটি ডেটা রেকর্ডার খুঁজে পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা আশা করছেন, সেদিন ঠিক কী হয়েছিলো, সে প্রশ্নের উত্তর এই ডেটা রেকর্ডার থেকে পাওয়া যাবে।
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের কর্মকর্তরা বলেছেন, জাহাজের কিছু কন্টেইনারে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি সহ ধ্বংসাত্মক, দাহ্য, বিপজ্জনক পদার্থ বহন করছিলো।
এর আগে অবশ্য মার্কিন কোস্টগার্ড জানিয়েছিলো যে জাহাজটিতে ১৫ লাখ গ্যালন জ্বালানি তেল ও কন্টেইনারে থাকা বিপজ্জনক পদার্থ থাকলেও তাতে জনসাধারণের কোনও বিপদ নেই।
সেতুতে ধাক্কা দেওয়া জাহাজটি সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী ছিল।
এক বিবৃতিতে সিঙ্গাপুরের মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি (এমপিএ) বলেছে, জাহাজ চলাচলের সমস্ত বিধিবিধান মেনেই এটি নদীতে চলছিলো।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেছে, তদন্তের ক্ষেত্রে তারা মার্কিন কোস্ট গার্ড সহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করছে।
ছবির ক্যাপশান,
বাল্টিমোর বন্দরের পানির তাপমাত্রা ছিলো ৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো।
দ্য বাল্টিমোর ব্রিজ, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে অবশ্য এটি পরিচিত ছিল 'দ্য কি ব্রিজ' নামে। এটি মেরিল্যান্ডের উনিশ শতকের কবি ফ্রান্সিস স্কট কি-র সম্মানে ১৯৭৭ সালে খুলে দেওয়া হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা।
পাটাপস্কো নদী এবং বাল্টিমোর বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত এ সেতু এক দশমিক ছয় মাইল (দুই দশমিক ছয় কিমি) লম্বা। এ নদী গিয়ে পড়েছে চেসাপিক উপসাগরে। এটিই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মোহনা।
এ সেতুকে ‘কন্টিনিউয়াস ট্রাস ব্রিজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, অর্থাৎ এর উপরের কাঠামোই হলো লোড বহনকারী অংশ এবং এটি একে অপরের সাথে সংযুক্ত ।
এর প্রধান স্প্যানটি ১২শ ফুট লম্বা, যা এ ধরনের যত ব্রিজ আছে দুনিয়ায় তার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম।
দুর্ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, কন্টেইনার জাহাজ ডালি সেতুটির একটি পিলারে আঘাত করার পর তাৎক্ষনিকভাবেই সেতুটি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে।
সেসময় বাল্টিমোর বন্দরের পানির তাপমাত্রা ছিলো নয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো।
মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে আসলে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। মানবশরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো।
ছবির ক্যাপশান,
জাহাজটি যখন সেতুর দিকে এগুচ্ছিল তখন একটি 'মে ডে সিগন্যাল' পাঠানো হয়েছিল জাহাজ থেকে।
সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী কন্টেইনার জাহাজ 'ডালি' গ্রিসের ওশানবাল্কের জন্য তৈরি করেছিলো হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ।
সর্বশেষ এটি চার্টার ভেসেল কোম্পানি সিনার্জি গ্রুপ পরিচালনা করছিল এবং সাময়িকভাবে এটি লিজ নিয়েছিলো সুপরিচিত শিপিং কোম্পানি মায়েরস্ক, কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
তারা জানিয়েছে তাদের গ্রাহকদের জন্য কার্গো বহন করছিল, তবে কোম্পানির কেউ দুর্ঘটনার সময় জাহাজে ছিলেন না।
শ্রীলংকার কলম্বোর উদ্দেশ্যে স্থানীয় সময় রাত বারোটা ২৪ মিনিটে বাল্টিমোর সিগার্ট মেরিন টার্মিনাল ছেড়েছিল জাহাজটি। ধারাবাহিকভাবে এর গতি বাড়ছিল এবং এটি পাটাপস্কো নদীতে একটি রুট ধরে সোজা চলছিলো।
রাত একটা পঁচিশের মেরিন ট্রাফিক ডেটা অনুযায়ী জাহাজটি হুট করে সোজা পথ থেকে সরে যায় ও গতি কমতে শুরু করে।
এই সময়ে ভিডিওতে দেখা যায় জাহাজটির বাইরের দিকের সব আলো বন্ধ হয়ে যায় এবং জাহাজের ফানেল থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। এর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটি সেতুতে আঘাত করে।
শিপটি যখন সেতুর দিকে এগুচ্ছিল তখন একটি 'মে ডে সিগন্যাল' পাঠানো হয়েছিল জাহাজ থেকে।
এটি কর্তৃপক্ষকে সেতুর ওপর যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে এবং ‘জীবন বাঁচাতে’ সহায়তা করেছিল বলে উল্লেখ করেছেন গভর্নর মুর।
তিনি বলেন, জাহাজটি ঘণ্টায় প্রায় নয় মাইল বা ১৫ কিলোমিটার গতিতে এগুচ্ছিল।
ইউএস সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার এজেন্সি এক আনক্লাসিফায়েড মেমো পেয়েছে, যার ভিত্তিতে বিবিসির যুক্তরাষ্ট্রর পার্টনার সিবিসি বলছে, ডালি ‘নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল’।
সিনার্জি বলেছে জাহাজটির ক্রু-রা ছিলেন ভারতীয় নাগরিক আর দুইজন পাইলট ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
তাদের আহত হবার কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
কোম্পানিটি বলছে দুর্ঘটনার অনেকগুলো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তবে দুই পাইলট থাকার পরেও এ ধরনের সংঘর্ষ ‘অস্বাভাবিক’।
একজন শিপিং বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন যে ইঞ্জিন ফেইলিওর, স্টিয়ারিং কাজ না করা কিংবা জেনারেটর ব্ল্যাকআউটের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।