শেখ হাসিনা তার সরকারের চতুর্থ বছর পূর্ণ করেছেন। বাংলাদেশে টানা সর্বোচ্চ ৯ বছর সরকার প্রধান থাকার রেকর্ডও সৃষ্টি করলেন তিনি। সে উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে টিভি-বেতার ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণের পর প্রধান বিরোধী দল হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে যে, প্রধানমন্ত্রী দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলেন। তারা তাদের দাবি অনুসারে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কোনও বক্তব্য প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কে তার প্রদত্ত ভাষণে কিছু বলেননি। বরং তিনি বলেছেন শাসনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচন হবে।
বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার পূর্বেই বলেছিলেন তিনি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দেবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা তিনি দেননি। আবার এমনও হতে পারে নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ২০১৩ সালের মতো মৃত বা অর্ধমৃত, অসুস্থ কিছু লোকের নাম দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি।
দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনকালীন সরকারের সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য রূপরেখা পেশ করবেন এবং জাতিকে তা বুঝানোর চেষ্টা করবেন, জনমত সৃষ্টি করবেন, সরকার তা না মানলে আন্দোলন করবেন- এটাই দাবি আদায়ের নিয়ম। আওয়ামী লীগ বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতাশীন হয়নি নিশ্চয়ই। আর বিএনপিও আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না।
এ বছর নির্বাচনের বছর। নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ অক্টোবর মাস থেকে আরম্ভ হবে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে নির্বাচন। অথচ বিএনপি দাবি আদায়ের জন্য কোনও প্রস্তুতিই নেয়নি। হয়ত বসে আছে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করলে নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দেবে, নির্বাচনের দিন কয়টা নির্বাচনি কেন্দ্রে আগুন দেবে। পথে পথে বোমা ফাটাবে আর আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। নির্বাচন শেষ হলে বলবে জনসাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছে। আর বাকি পাঁচ বছর গীত গাইবে ‘অর্নিবাচিত সরকার’।
সরকারি দল হিসেবেও বিএনপি ব্যর্থ ছিল। ক্ষমতায় থাকতে সীমাহীন দুর্নীতি, বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র হাওয়া ভবন তৈরি, বিরোধী দলকে গ্রেনেড মেরে নিঃশ্বেষ করার রাজনীতি করেছে তারা। বিরোধী দল হিসেবেও ছিল বিএনপি ব্যর্থ। দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করেছে। বেতন ভাতা টিকিয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝে হাজিরা দিয়েছে। সংসদ একেবারে ছেড়ে রাজপথে আসার সাহস এবং যুক্তি কোনোটাই তারা দেখাতে পারেনি। এখনতো বলাই যায়, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও এককভাবে থাকলে বিএনপি সফল হতো না। সফল হয়েছিলো সঙ্গে আওয়ামী লীগ ছিল বলে।
বিএনপি নেতৃত্ব এখন সবাই বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ফলাফলের দিকে চেয়ে আছেন। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানি প্রায় শেষ। অরফানেজ মামলার রায় সন্নিকটে। হয়তো দুটি মামলার রায় একসঙ্গেও হতে পারে। এখানেই শেষ না। সচল করা হয়েছে গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলাগুলো। তার পরে আছে আগুন-এসিড-বোমা আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে সংঘটিত নৈরাজ্যের ঘটনায় হুকুমের আসামি করে তার বিরুদ্ধে যেসব নাশকতার মামলা হয়েছে সেসব।
রায় সম্পর্কে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয় উচিতও নয়। মওদুদ থেকে শুরু করে বিএনপি লবির আর কোনও বড় আইনজীবী অবশিষ্ট নেই যে এই মামলায় তার পক্ষে লড়েননি। প্রায় ১৫০ বার অনুপস্থিতি ছিলেন তিনি। লন্ডনে গিয়ে ৩৩ বার হাজিরা না দেওয়ার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর দেশে এসেছেন এবং সাপ্তাহিক ভিত্তিতে জামিন নিয়ে হাজিরা দিয়ে চলছেন।
মামলার সাজার আগেই বেগম জিয়ার জন্য বড় সাজা হচ্ছে সপ্তাহে দু’বার সকাল বেলায় হাজিরা দেওয়া (কলামের জন্য উকিলদের দায়ের করা মামলায় সপ্তাহে দু’বার ঢাকার নিম্ন আদালতে হাজিরা দেওয়ার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)। বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মীরা এই মামলায় যা আশঙ্কা করছেন সেটা হচ্ছে রায়ে যদি খালেদা জিয়া দণ্ডিত হন আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যেমনটা আওয়ামী লীগের ৯৬ সালের শাসনামলে দণ্ড পেয়ে এইচ এম এরশাদ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
অন্যদিকে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হত্যা মামলারও বিচারিক প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই মামলার রায় হবে অল্প কিছু দিনের মাঝে। তবে গ্রেনেড হত্যা মামলা থেকে তারেক জিয়া, আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরীর মতো লোকেরা পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হবে বলে মনে হয় না। জর্জ মিঞাকে প্রধান আসামি করে প্রথম যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিলো তা তো একটা প্রহসন ছিল বলে প্রমাণিত। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে খোদ সরকার এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল।
আব্দুল কাহার আকন্দ ছিলেন শেষ আইও। তিনি একজন অভিজ্ঞ অফিসার। তার প্রদত্ত চার্জশিট থেকে আসামি খালাস পাওয়া খুবই কঠিন। মনে হয় গ্রেনেড হত্যা মামলায় বেশ কিছু লোকের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হবে। তারেকের হাওয়া ভবনে এবং পিন্টুর বাসায় পরিকল্পনা হয়েছিলো, স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বাবর পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করেছে, আর মুফতি হান্নানের কর্মীরা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে– এই তো দৃশ্য। যে দৃশ্য সাধারণ মানুষের চোখ এড়াচ্ছে না সে দৃশ্য বিজ্ঞ বিচারকের চোখ এড়াবে কিভাবে?
ন্যায় বিচারকের হাতে আইন নির্মম। ন্যায় বিচারক আর আইনের কোনও আত্মীয় নেই। তারা এক ও অভিন্ন। তারাই পরস্পরের আত্মীয়। কৌশলের মধ্য দিয়ে মিথ্যা যেন না জেতে এটাই একটা বিচারক নিশ্চিত করে থাকেন। যে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন লোক নিহত হয়েছে তার ব্যাপারে তো বিচারক খুবই সতর্ক থাকবেন। যে মামলা তিনবার তদন্ত হয়েছে, যে মামলায় বিচারের রায়ের আগে প্রথম তদন্ত রিপোর্টের প্রধান আসামি খালাস পেয়ে এখন টঙ্গিতে কাজ করছে– এমন একটি রহস্যঘেরা বিচারের রায়ও চাঞ্চল্যকর হবে ধরে নেওয়া যায়।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়ার দণ্ড হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। টাকা এতিমের জন্য এসেছিলো, এতিম যদি টাকা না পেয়ে থাকে তবে টাকা কোথায় গেলো তার জন্য জবাবদিহিতাতো করতে হবে। যদি আদালত সন্তোষজনক জবাব না পায় তবে যার হাতে টাকা ছিল তার তো টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাস্তি হবেই। যে খুন করলো খুনের দায় তো তাকে বহন করতে হবে।
জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কাসুরীকে হত্যার হুকুম দিয়েছিলেন। যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো তার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সামনের সিটে বসা কাসুরীর আব্বা নিহত হয়। হুকুমের আসামি হিসেবে ভুট্টো ফাঁসির হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।
২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটি পুরোপুরি সফল হলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যেত। নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করার জন্য এত বড় হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালা বাগ ছাড়া আর কোথাও হয়নি। আরেক জালিয়ানওয়ালা বাগের হোতারা কিভাবে দাবি করবে এটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা! আদালতের জেরা এবং সরকারি প্রাক্তন কর্মকর্তাদের সাক্ষীতে পরিষ্কার যে, ২১ আগস্ট সৃষ্টির পেছনে তৎকালীন সরকারের সরাসরি হাত ছিল।
বিএনপি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য হত্যার পথ বেঁছে নিয়েছিলো। জিয়াউর রহমানের সময় আওয়ামী বিরোধী শক্তিকে নিজের পক্ষে নিরঙ্কুস করার জন্য বায়তুল মোকাররামে সামনের ময়দানে খন্দকার মোস্তাকের জনসভায়ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিলো বিএনপি। ১৪ জন লোক সভার মাঠে মারা গিয়েছিলো। গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় খন্দকার মোস্তাক, অলি আহাদ, শাহ মোয়াজ্জম, পীর দুদু মিঞাসহ মঞ্চে উপবিষ্ট ৫০/৬০ জন নেতা বেঁচে গিয়েছিলেন। গ্রেনেড মেরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হত্যা, বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে ছাত্র নেতা-জননেতা কেনা বেচা, এসব সংস্কৃতি রাজনীতিতে এনেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার ধারাবাহিকতা বেগম জিয়া আর তারেক জিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।
জিয়ার পরিণতি জিয়া ভোগ করেছেন। বেগম জিয়া আর তারেক জিয়ার পরিণতি কী হবে আল্লাহ ভালো জানেন। তবে তাদের কর্মদ্বারা তারা প্রমাণ করেছেন তারা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে খুবই নির্মম। সময়ে সময়ে ক্ষমতার লিপ্সা তাদের মনুষত্বের আলোকশিখা নির্বাপিত করে দেয়। ২০১৩ সালের শেষ চার মাস সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে ৩১৯ জন লোক হত্যা আবার ২০১৫ সালে প্রথম ৯৩ দিন বোমা মেরে ১৫২ জন মানুষ হত্যা– এরই নমুনা। যারা হত্যার শিকার হয়েছে তারা কেউই তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, এরা ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
বেগম জিয়াকে তার শুভাকাঙ্ক্ষিরা এই পরামর্শ দেওয়া উচিত– মামলার পরিণতি যাই হোক না কেন তিনি যেন নির্বাচন ত্যাগ না করেন। গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, আর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি তো জিতেছিলো। তখনও তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। বেগম জিয়ার পক্ষে বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে আর মামলার পর মামলায় জালে পড়ে– উত্তাল আন্দোলন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। দলীয় অবুঝরা হয়তো এমন কথা শুনতে অভ্যস্ত নন কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
দীর্ঘ ১১ বছর দল ক্ষমতার বাইরে। এতো বছর দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে দলের নেতা কর্মীদের মাঝে হতাশা আসে। এখন বিএনপির কর্মীদের মাঝে সেই হতাশা বিরাজ করছে। দলকে রক্ষা করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা নেই। আমাদের দেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর অনেক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ শুনেছি। তারা বলছেন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের কিছু সাংসদ পদত্যাগ করবেন আর সে সব কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন করে বিএনপি প্রার্থীকে জিতিয়ে এনে মন্ত্রী বানাবেন। এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ শরীক হবে তারা তা চিন্তা করে কিভাবে!
আমরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো বিএনপি যদি নির্বাচনে যোগ দিতে সম্মত হয় তবে টেকনোক্রেট কোটায় যেন বিএনপির থেকে দু-একজন লোককে মন্ত্রী করেন। বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেলনা যেমন নয় তেমনি অপরিহার্য কিছুও নয়। নিজেকে অপরিহার্য করে রাখার ব্যাপারে নিজেকে সচেষ্ট হতে হয়। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে আম-ছালা সবই হারাবে। হালুয়া রুটিতে অভ্যস্ত দলও বিভক্ত হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
মামলার রায়ের পরে পরিস্থিতি যেদিকেই মোড় নিক বেগম জিয়ার উচিত হবে নির্বাচনের বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি ত্যাগ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তাতেই তার মঙ্গল। দলের মঙ্গল। দেশেরও মঙ্গল। বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় আনার জন্য বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরও আসবে না, ভারতও সীমান্তে সেনা সমাবেশ করবে না। তাদের মিত্র পাকিস্তানেরতো কোনও ক্ষমতাই নেই এই ক্ষেত্রে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক