শুক্রবার ভোর। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে গর্জে উঠল দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান। ইসরাইলি বিমানবাহিনীর এক বিশাল বহর হানা দিলো ইরানে। লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট, ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে ধ্বংস, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা গুঁড়িয়ে দেয়া, আর সর্বশেষে নাতাঞ্জ ও ফোরদু পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানা।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তখন ঘোষণা দিলেন, যতদিন প্রয়োজন এবং যতক্ষণ না ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ধ্বংস হয়, এই অভিযান চলবে। অথচ ইসরাইল নিজেই একটি ঘোষণাহীন পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। তারা বরাবরই একটি পারমাণবিক ইরানকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে এসেছে। কিন্তু চাপার জোর আর বাস্তবতা এক নয়। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরাইল কি সত্যিই একা ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে পারবে?
নাতাঞ্জ ও ফোরদু হলো ইরানের পরমাণু হৃদস্পন্দন। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হলো নাতাঞ্জ এবং ফোরদু। নাতাঞ্জ শহরের কাছে অবস্থিত এই স্থাপনাটি মাটির অনেক গভীরে, বহুস্তরবিশিষ্ট একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের মতো, যেখানে রয়েছে সেন্ট্রিফিউজ, বিদ্যুৎঘর আর অত্যাধুনিক পারমাণবিক অবকাঠামো। আর ফোরদু? সেটা তো আরো এক কাঠি সরেস। ইরানের পবিত্র এবং ধর্মীয় নগরী ক্বোম-এর অদূরে একটি পাহাড়ের গভীরে লুকানো পারমাণবিক স্থাপনা। ফোরদুকে ধ্বংস করতে গেলে চাই একাধিক ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা। এই ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই ফোরদু নির্মিত হয়েছিল। শত শত ফুট পাথরের নিচে গাঁথা কংক্রিটের প্রলেপে মোড়া এ ঘাঁটিকে ধ্বংস করা কোনো সাদামাটা বোমা বা হামলার কাজ নয়।
বাঙ্কার-বাস্টার বোমার ক্ষেত্রে ইসরাইলি সীমাবদ্ধতার কথা আজ সবাই জানেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি-টু স্টিলথ বোমার মতো বিমানে বহনযোগ্য ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা এই ধরণের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের জন্য তৈরি। কিন্তু ইসরাইলের হাতে এমন অস্ত্র নেই।
তার যা আছে, তা হলো এফ-১৫ যুদ্ধবিমানে বহনযোগ্য ৪০০০-৫০০০ পাউন্ডের জিবিইউ-২৮ বাঙ্কার-বাস্টার বোমা। কিন্তু এই বোমা দিয়ে সর্বোচ্চ ৫-৬ মিটার গভীর কংক্রিট ভেদ করা যায়, যেখানে নাতাঞ্জ বা ফোরদুর গভীরতা তার চেয়েও অনেক বেশি।
মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক জেনারেল চার্লস ওয়াল্ড বলেন, ইসরাইলের হাতে যতটুকু ৫০০০ পাউন্ডার বোমা আছে, তা দিয়ে নাতাঞ্জ বা ফোরদু একেবারে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।
স্থলপথ নয়, আকাশপথেই অভিযানের নির্ভর করতে হচ্ছে ইসরাইলকে। ইসরাইল বাহিনী তাদের স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র যুদ্ধবিমান থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র যা সিরিয়ার আকাশসীমা দিয়ে ইরানে ঢুকে পড়ে দূর থেকে হামলা চালাতে পারে। কিন্তু এতেও সমস্যা আছে। এই অস্ত্রগুলো পারমাণবিক স্থাপনা দুটোর বড়জোর ক্ষতি করতে পারবে, ধ্বংস নয়।
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ম্যাথিউ স্যাভিল বলেন, ইসরাইল একাই ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করতে পারবে, এমন নয়। তবে তারা চাইলে বারবার হামলা চালাতে পারে।
ইরানের গোপন মজুত রয়েছে বা পরমাণু ক্ষেত্রে দ্রুত উৎকর্ষ সাধন কী চলছে? জাতিসঙ্ঘের পারমাণবিক নজরদার সংস্থা আইএইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ইরানের কাছে ৪০৮.৬ কেজি ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ছিল। মাত্র ৩ সপ্তাহের মধ্যে ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধিতে পৌঁছে। এ দিয়ে নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব বলে জানায় ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি।
এই মজুতের বড় একটি অংশ ইরানের ইসফাহানের ফুয়েল প্লেট ফ্যাব্রিকেশন প্লান্টে (এফপিএফপি) সরানো হয়েছে বলেও সন্দেহ। ডারিয়া ডলজিকোভা ব্রিটিশ পারমাণবিক বিশ্লেষক বলেন, নাতাঞ্জ বা ফোরদু ধ্বংস করলেই ইরানের পরমাণু ল্যাঠা চুকে গেল ভাবলে চলবে না। কারণ ইরানের গোপন স্থাপনাও থাকতে পারে। ফলে পুরো কর্মসূচি নিশ্চিহ্ন করা কঠিন।
ইরান প্রস্তুত ছিল, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সক্রিয়। ২০২৪ সালে ইসরাইল ইরানে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, যা ইরানের রুশ-সরবরাহকৃত এস-৩০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও অকার্যকর করে দেয়। এইবারের হামলায়ও ইসরাইল প্রথমে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেয়- ‘ডজনখানেক রাডার আর ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক ধ্বংস হয়েছে বলে জানায় ইসরাইলি বাহিনী। কিন্তু ইরানও ফাঁকা মাঠে গোল খেতে রাজি নয়। তাদের হাতে রাশিয়া ও চীন থেকে আসা সক্ষম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। ইসরাইলি প্রথম হামলা থেকে রক্ষা পেয়ে পরে এসব ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইরানের পাল্টা হামলা ও পরবর্তী যুদ্ধের রূপ রেখা। ইসরাইলের আকাশজুড়ে ১৮ জুন সন্ধ্যায় যখন আতঙ্কের সাইরেন বেজে উঠছিল, তখন অনেকেই বুঝে গিয়েছিলেন, এ আর শুধু হুমকি নয়। বাস্তবেই মাটিতে নামা শুরু করেছে প্রতিশোধের আগুন। ইরানের ইসলামি রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এ হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’। অর্থাৎ ‘সত্য প্রতিশ্রুতির তৃতীয় পর্ব’।
এ হামলার অংশ হিসেবে ইরান প্রথমবারের মতো সিনজিল নামের একটি নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এ এক ভয়ঙ্কর বার্তা, তেল আবিবের আকাশে যখন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন বুঝে নিতে সময় লাগেনি, পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ এখন কেবল ছায়ায় নয়, আগুনেও।
ইরানের মেহর নিউজ আলাদা আলাদা খবরে আরো জানিয়েছে, ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য নরকের দরজা খুলে দিয়েছে ইরান। আইআরজিসির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছি। এখন দখল করা অঞ্চলের আকাশ ইরানি ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্রের আলিঙ্গনের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত।’
এই বিপ্লবী বাহিনী আরো বলেছে, এই মুহূর্তে অবৈধ বসতির বাসিন্দাদের সামনে দুটি পথ- হয় বাঙ্কারে বসে ধীরে ধীরে মৃত্যু, নয়ত দখল করা ফিলিস্তিন ত্যাগ করে জান নিয়ে পালিয়ে যাওয়া।
২০২৪ সালে দু’টি ইরানি হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ধ্বংসকারী জাহাজ ও যুক্তরাজ্যের আরএএফ জেট ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করেছিল। কিন্তু এবার ব্রিটেন জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর সাহায্যে আসছে না।
তদুপরি, ইসরাইল নিজেই স্বীকার করছে, তার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কমে গেছে। নিজের অ্যারো ইন্টারসেপ্টর তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বলেছে, তাদের এখন তিন পালায় কাজ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, ইরান প্রতি মাসে প্রায় ৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। তার মজুত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য গোপন।
একা ইসরাইল কি পারবে ইরানের সাথে? হ্যাঁ এমন প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ এবং ‘বম্বিং টু উইন’ গ্রন্থের লেখক রবার্ট পেইপ বলেন, ইসরাইলের বিমান শক্তি একা হাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, এই হামলার পরিণামে এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেমনটা হয়েছিল ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়।
নাতাঞ্জ ও ফোরদু একেকটা দুর্গ। যেখানে শুধু অস্ত্র নয়, লুকিয়ে আছে একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যত, আশঙ্কা আর প্রতিশোধস্পৃহা। পাহাড় আর কংক্রিটের স্তরে স্তরে শুধু ইউরেনিয়াম নয়, আছে এক অসমাপ্ত যুদ্ধের ছায়া। এই মুহূর্তে ইসরাইল হয়তো কিছুটা ধাক্কা দিতে পেরেছে। কিন্তু পুরো পরমাণু কর্মসূচি নিশ্চিহ্ন করা কিংবা তেহরানের ক্ষমতা কাঠামো ভাঙা, তার একার আকাশযুদ্ধ দিয়ে সম্ভব নয়। এই যুদ্ধ লড়তে হলে সরাইলকে শুধুই আকাশ নয়, ইতিহাসের মাটি, কূটনীতির ছায়া আর বাস্তবতার দেয়ালও ভেদ করতে হবে। আর সেটাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ, ইরান তখন বসে বসে হুক্কা টানবে না। দর্শক হয়ে থাকবে না।