জহির রায়হান উপন্যাস সমগ্রে পাঁচটি উপন্যাস রয়েছে। প্রথম উপন্যাস ১৯৬০ সালে প্রকাশিত শেষ বিকেলের মেয়ে- একটি রোমান্টিক প্রেমের উপাখ্যান। দ্বিতীয় উপন্যাস ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হাজার বছর ধরে- আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত একটি আখ্যান। তৃতীয় উপন্যাস ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত আরেক ফাগুন- বায়ান্নের রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কথামালা। চতুর্থ উপন্যাস ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত বরফ গলা নদী- অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা। পঞ্চম ও শেষ উপন্যাস ১৯৭০ সালে প্রকাশিত আর কত দিন- অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্মার আন্তর্জাতিক রুপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্মকথা।
জহির রায়হানের উপন্যাসে মুসলিম মানস চিত্রিত হয়েছে নিরপেক্ষ জীবনবোধের নিরীখে। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে জহির রায়হান ছিলেন পাকিস্তানের ধর্ম নিয়ে অপব্যাখ্যা এবং রাজনীতিতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের নেতিবাচক বিরোধী ও পুরধা কথাশিল্পী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি ষাটের দশকে এক পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন অসাম্প্রদায়িক মানব ধর্মে দীক্ষিত জীবন বীক্ষায়। ফলে তৎকালীন সাধারণ বাঙালি জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় তিনি অগ্রণী হয়ে ওঠেন। শুধু আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন নয় ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয় সমসাময়িক লেখক-শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন রাজনীতির প্রতি সবচেয়ে বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাঁর কোনো উপন্যাসেই তিনি জীবনের চেয়ে শিল্পকে বড় করে তুলে ধরেননি বরং জীবনই তাঁর উপন্যাসে প্রধান উপজীব্য। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই জীবনের সংশ্লেষণ। তিনি বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের অন্যতম প্রধান জীবনভাষ্য রচয়িতা। তাঁর ভাষার সরলতা, ঋজু দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিজ্ঞান সম্মত বিশ্লেষণ তাঁকে বাঙালি মুসলমানের স্বার্থক কথকের আসন দিয়েছে। নজিবর রহমান, কাজী ইমদাদুল হক প্রমুখের হাতে বাঙালি মুসলমান কথাশিল্পের যে ভিত রচিত হয়েছিল; আবু ইসাহাক হয়ে সেই স্রোতই জহির রায়হানে আরও সুদৃঢ় হয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর কথপোকথন স্বাবলীলভাবে বাঙালি মুসলমান মানস ও মননকে মূর্ত করে তোলে। তিনি নিজস্ব মতবাদ আরোপের পথে না এগিয়ে চরিত্রগুলোর আপন ভাষ্য বিনির্মাণের সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। যার কারণে তাঁর উপন্যাসগুলো পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে সক্ষম হয়।
কয়েকটি উদ্ধৃতি ও তাঁর বিশ্লেষণ থেকে জহির রায়হানের উপন্যাসে মুসলিম মানস সম্পর্কে সম্যক ধারনা পাওয়া যাবে।শেষ বিকেলের মেয়ের থেকে উদ্ধৃতি-
‘কাসেদের মা ম্লান হেসে বলতেন, নামাজের নাম নিলেই তোমার গায়ে জ্বর আসে কেন বলতে পারো? কাসেদের বাবা নির্বিকার গলায় জবাব দিতেন, বেহেস্তের প্রতি আমার লোভ নেই। তোমার যদি থেকে থাকে তুমি যেয়ো, আমি তোমার পথ আগলে দাঁড়াবো না।’
বেহেস্তের প্রতি কাসেদের বাবার এই অনাকর্ষণ জন্মেছিল সম্ভবত রুশ বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও গণচীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর সাম্যবাদী ধ্যান ধারণায় উজ্জীবন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রত্যাশা পরণ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে।
হাজার বছর ধরে র থেকে উদ্ধৃতি-‘ফকিরের মা বুড়ি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে বললো, বাপু গেলেই কি অইবো আর না গেলেই কি অইবো। যার মউত আল্লায় যেইদিন লেইখা রাখছে সেই দিন অইবো। কেউ আটকাইবার পারবো না।’
এর মধ্য দিয়ে হাজার বছর ধরে মুসলিম মানস তথা সাধারণ মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে আরোপিত কিছু নেই। ঔপন্যাসিক জহির রায়হান এখানে কুসংস্কার মুক্ত করতে গিয়ে সাম্যবাদের মতামত আরোপ থেকে বিরত থেকে সত্যনিষ্ঠ পেশাদার কথকের প্রমাণ দিয়েছেন।
হাজার বছর ধরে- উপন্যাসে মকবুলের মৃত্যুর পর ছোট বউ টুনির বাপের বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে এভাবে-‘একে একে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিল টুনি। সবার গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ ধরে কাঁদলো সে। পরীর দীঘির পাড়ের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দর থেকে বুড়ো মকবুলের কবরটা চোখে পড়লো শুকনো মাটির ঢেলাগুলো ঢিপির মতো উঁচু হয়ে আছে। সে দিকে তাকাতেই সারাদেহ কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী এক অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে যেন।’
বাঙালি মুসলমান বউয়ের মনে এই কবর ভীতি তথা পরকাল ভীতির এক নির্মোহ কথন এবং নির্মেদ ভাষা স্বাতন্ত্র এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
বরফ গলা নদী উপন্যাসে সালেহা বিবির নামাজ পড়ার বিষয়গুলো বেশ কয়েকবার এসেছে। সংসারের আর্থিক উন্নতির জন্য দোয়া খায়েরের বিষয়াবলিও বাদ পড়েনি। ছা-পোষা কেরানীরও সালেহা বিবির ছবি তোলা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে:
‘সালেহা বিবি বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মরবো, ফটো তুললে গোণাহ হয়। মনে মনে তারও ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কার বার বার বাধা দিচ্ছিলো এসে।’
এই বর্ননার মধ্যে তৎকালীন বাঙালি মুসলিম নারীর দ্বন্দ্ব স্বাবলীলভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
একই উপন্যাসের নায়ক মাহমুদ সালেহা বিবির বড় ছেলে। সে এক পত্রিকা অফিসে সহকারি সম্পাদকের চাকরি করতো। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট পত্রিকার মালিকের বিরুদ্ধে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশন করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এ নিয়ে প্রতিবাদের শক্তিও তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মালিকের উপর রুষ্ট থাকায় তার বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি দীর্ঘ দিন গাধার নাকের উপর মুলোর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে তিক্ত বিরক্ত হলে তার চাকরি চলে যায়। কিছু দিন বেকার থাকার পর সে প্রেসে প্রুফরিডারের কাজ নেয়। বড়লোকের চরিত্র সম্পর্কে সব সময় সে নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি পোষণ করতো। ধনী পাত্রের সাথে তার বোন মরিয়মের প্রেমের পর বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের কথপোকথন মুসলিম মানস বিশ্লেষণে প্রণিধানযোগ্য:
‘দেখো মা খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা না করে, নাস্তাপানি খাইয়ে সকলকে বিদায় দেবার বন্দোবস্ত কর। গরিবের অত ভোজ খাওয়াবার চিন্তা না করাই ভালো। মা বললেন, গরিব হয়েছি বলে বুঝি সাধ-আহ্লাদ নেই আমদের? মাহমুদ মৃদু হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো- মা, রোজ পাঁচ বেলা যার কাছে মাথা ঠোকো, তাকে ভুলেও কি একবার জিজ্ঞেস করতে পারো না, এত সাধ-আহ্লাদ দিয়ে যদি গড়েছেন, তোমাদের, সেগুলো পূরণ করার মতো সামর্থ্য কেন দেননি।এ কথার তাৎপর্য ঠিক ধরতে পারলেন না সালেহা বিবি। তাই চুপ করে রইলেন তিনি।ও ঠিক বলেছে। ছেলেকে সমর্থন জানালেন হাসমত আলী- অত ভোজ দেবার কী দরকার, আমাদের সামর্থ্য যখন নেই..।’
এ বর্ননার ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের মানস বস্তুনিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে। ভাববাদ ও ভাবালুতা বিবর্জিত মাহমুদ শ্রেণি চেতনার নিরীখে করণীয় নির্ধারণ করতে তৎপর। তাই প্রগতিবাদী চিন্তা চেতনার ধারক বাহক হিসেবে বরফগলা নদী উপন্যাসে মাহমুদের চরিত্রটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। রুশ বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও গণচীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর সাম্যবাদী ধ্যান ধারণাপুষ্ট হয়ে তৎকালীন পর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান মানসে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তারই প্রতীক হিসেবে মাহমুদ চরিত্রটি পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঙালি মুসলমান মানসে ধর্মীয় অনুশাসনের অবয়বে বঞ্চনা ও গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করার যে বৈশিষ্ট্য তা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে মাহমুদ। সেই কাল পর্বে জগদ্দল বরফের শিলা গলে মুক্তির এক কালজয়ী নদীপথ সৃস্টি হয়েছিল বাঙালি মুসলিম মানসে। এ কালসত্যকে ধারন করতেই যেন মাহমুদ ব্যতীত ছা-পোষা হাসমত আলীর সমগ্র পরিবার অবিরাম বর্ষণে জীর্ণ শীর্ণ দালান ধ্বসে মৃত্যুবরণ করে।
জহির রায়হানের উপন্যাসের আয়নায় বাঙালি মুসলমানের মানস বিবিধ অনুষঙ্গে বিম্বিত হয়েছে জীবন বাস্তবতার সামগ্রিকতায়। মুসলিম মানসের ক্রম উৎকর্ষিত জীবনবোধ তাঁর উপন্যাসে প্রাণোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে- অমিত প্রাণ সঞ্চারী শিল্পমাধুর্যে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক