আজ ২৯ জানুয়ারি ৮টি মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে ফাস্ট ট্র্যাক টাস্কফোর্সের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।





অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্র বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ৮টি মেগা প্রকল্পের গড় অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। উল্লেখিত প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করতে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ২৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

অগ্রাধিকার পাওয়া ৮টি মেগা প্রকল্প হলো- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম (মিয়ানমারের কাছে) পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।

অনেক প্রকল্পই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগেই উদ্বোধন করা হয়। কিছু কিছু কাজ বাকি থেকে যায়। যেমন-পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে গেল বছরের ২৫ জুন। সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচলও করছে নির্বিঘ্নে। কিন্তু প্রকল্পটির নদীশাসনসহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ এখনো চলমান। আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ বাকি রয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৫৩৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৪ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ভৌত অবকাঠামোগত অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ। কয়েক দফা প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং সর্বশেষ মেয়াদে কাজটি ২০২৩ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হওয়ার কথা। মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। পরীক্ষামূলকভাবে এ ব্যবস্থাপনায় যাত্রী পরিবহণের কাজটিও চলছে। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজটি আংশিক। প্রকল্পটির পুরো বাস্তবায়ন হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল এবং সম্প্রসারিতভাবে কমলাপুর পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ সম্ভব হবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হবে এবং কমলাপুর পর্যন্ত সময় লাগবে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় করা হয়েছে ২১ হাজার ১১৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে প্রকল্পটির ভৌতিক অগ্রগতি হয়েছে ৭০ শতাংশ। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫৮ হাজার ২৬৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।

সে হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫১ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সময় বাড়িয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধার্য করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আরেকটি বড় প্রকল্প হলো পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা। শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৩৬৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

সেই অর্থে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, আর ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রকল্পটি শেষ করতে মোট ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রকল্পটি ২০২৬ সালে জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা।

শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৫৫১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এতে করে আর্থিক অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে ৫৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতির হার দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৭৬ শতাংশে। ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের প্রকল্পটি হলো রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতির দিক থেকে প্রকল্পটি এগিয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে এবং ভৌত অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম রেল ট্র্যাক নির্মাণ কাজের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ২১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ অর্থে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশে এবং ভৌত অগ্রগতি দাঁড়ায় ৭৮ শতাংশে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের বক্তব্য হলো, ‘বাস্তবায়ন ভালোই হচ্ছে। চলমান ডলার ও আর্থিক সংকট এসব প্রকল্পগুলোকে যাতে ছুঁতে না পারে, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রয়োজনে অন্য প্রকল্প বা খাতের ব্যয় কমিয়ে হলেও এসব প্রকল্পের জন্য অর্থ জোগান দেওয়া হচ্ছে। তার পরও যদি কোথাও কোনো সমস্যা থেকে থাকে, সেগুলো সমাধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ আমরাও চাই প্রকল্পের যথাসময়ে এবং যথাযথ বাস্তবায়ন। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ সমাধা করতে না পারলে এর আর্থিক দায় অনেকখানি বেড়ে যায়। এর সঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।

যেকোনো অর্থনীতির সমৃদ্ধির সঙ্গে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন একটি অপরিহার্য শর্ত। যেমন-পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে আশা করা যাচ্ছে জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে তর্কের কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেটা থেকে যায় তা হলো, এ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বণ্টন সাধারণ মানুষ সমহারে পাবে কিনা কিংবা পাচ্ছে কিনা। কারণ আমাদের মতো শাসনব্যবস্থায় সম্পদ যত বাড়ে, বৈষম্যও তত বাড়ে; অন্তত বিগত ৫০ বছরের অতীত তা-ই বলে। মানুষের আয়-বৈষম্যকে বিশেষজ্ঞরা যা দিয়ে পরিমাপ করেন, তার নাম ‘জিনি সহগ’ (Gini Coefficient)। এর মান যদি ০ হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই অর্থনীতিতে আয় সম্পূর্ণ সমভাবে বণ্টিত। আর যদি মান ১ হয়, তাহলে বুঝতে হবে সব আয় একজনের হাতে পুঞ্জীভূত। বাস্তবে এর কোনোটিই হয় না। তাই জিনি সহগের মান ০ থেকে যতই ১-এর দিকে ধাবিত হবে, ধরে নিতে হবে সেই অর্থনীতিতে বৈষম্য ততই বাড়ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে এই সহগের মান ছিল ০.৩৩; বর্তমানে এর মান ০.৪৮। এতে বোঝাই যাচ্ছে যে আয়-বৈষম্য বাড়ছে; সমৃদ্ধির সুফল সবাই ভোগ করতে পারছে না, পারছে গুটিকয়েক মানুষ।

সরকারি মহলের পক্ষ থেকে প্রকল্পগুলোর সফলতার চিত্র যতটা ফলাও করে প্রচার করতে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের মহাদুর্ভোগের সামান্য উপলব্ধিও প্রকাশ পেতে দেখা যায় না। বরং লোকসানের অজুহাতে দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, ডিসেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা ভোক্তা পর্যায়ে ১২ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এরপর বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এক মাস যেতে না যেতে শোনা যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১০ বার, আর খুচরা পর্যায়ে ১১ বার। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সম্ভানার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হলো, ‘জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসতে চায় সরকার। বিশেষ করে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে। শিল্পেও বাড়তি গ্যাসের দরকার। এ কারণে আমদানি বাড়াতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম কিছুটা সমন্বয় করার প্রয়োজন হতে পারে।’ ধারণা করা হচ্ছে, পাইকারি পর্যায়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়বে। সরকারি পর্যায় থেকে দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখানো হয়, কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষ কোথা থেকে সেই অর্থ জোগাড় করবে তার কোনো পথ দেখানো হচ্ছে না। আমাদের দুর্বলতা হলো, প্রতিবাদের ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আর সরকার সাধারণ মানুষের এ অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমরা আহ্বান জানাব, এ প্রক্রিয়াটি যেন আপাতত বন্ধ রাখা হয়। তা না হলে মূল্যস্ফীতির অধিকতর চাপে পিষ্ট হবে সাধরণ মানুষ, যাদের কথা ভাবার কেউ নেই।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews