দেশে সাধারণত সেপ্টেম্বরের পর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে। তবে এই ধারাকে উপেক্ষা করে গত বছরের মতো এবার নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসেও এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপ ঊর্ধ্বমুখী। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে দৈনিক গড়ে হাজারখানেক রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গুরুতর অসুস্থতরা মারা যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বছরজুড়ে মশা নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দেশে মশার সব ধরনের প্রজননস্থল চিহ্নিত করা হচ্ছে না। মশক নিধন কার্যক্রমেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কম। ফলে ডেঙ্গু ভাইরাস বছরব্যাপী ভোগাচ্ছে। রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে সারা দেশের হাসপাতালে আরও ৩৫৪ জন ভর্তি হয়েছেন। এ সময় রোগটিতে মারা গেছেন ৩ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৭৯৪ জনে। আর মোট প্রাণহানি হয়েছে ৪৮৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় যে তিনজন মারা গেছেন, তাদের সবাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে ১৭৬ জন, ঢাকা বিভাগে ২৪৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪১ জন, চট্টগ্রামে ৩৮ জন, খুলনায় ২৫ জন, ময়মনসিংহে ২২ জন, বরিশাল বিভাগে ৫ জন এবং রংপুর বিভাগের হাসপাতালে একজন ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ২৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২৫৫ জন; আর ১ হাজার ৭৭৩ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এ বছর মোট ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৪ হাজার ৪৬৬ জন ঢাকার বাইরের রোগী। ঢাকার দুই মহানগর এলাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৬ হাজার ৩২৮ জন। এ বছর সবচেয়ে বেশি ৩০ হাজার ৮৭৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছে অক্টোবরে, মৃত্যু হয়েছে ১৩৫ জনের। নভেম্বরের ২৯ দিনে ২৮ হাজার ৯৭৭ জন ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের। এক মাসে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যু।
জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, এর মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চে আক্রান্ত হন ৩১১ জন, এর মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। মে মাসে ৬৪৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুনে ৭৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে আটজনের। জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আগস্টে ৬ হাজার ৫২১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, এর মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।
জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, এডিস মশার বংশবিস্তার এখন আর বর্ষা মৌসুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কারণ হলো-মশার ডিম ফুটে লার্ভা হওয়ার জন্য যতগুলো নিরাপদ উপাদান থাকা দরকার পরিবেশে তার সবই বিদ্যমান। যেমন অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, (অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম), আর্দ্রতা, অনুকূল বাতাস প্রবাহ ইত্যাদি। ১২ মাসের মধ্যে কিছুদিন ছাড়া সব সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে মশা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ঢাকাসহ দেশের সব জায়গা এডিস ও কিউলেক্স সব ধরনের মশার ব্রিডিং-সাইডের সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাজধানীর জলাশয়গুলোতে পানি কমে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়ে যাচ্ছে। বাসাবাড়িতে জমে থাকা সামান্য পানিতে এডিসের লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে মশা নিধন হচ্ছে না অভিযোগে সবাই সরকার ও সিটি করপোরেশনকে দায়ী করছে। কিন্তু মশার সব ধরনের প্রজননস্থল চিহ্নিত করে তা ধ্বংসে নিজেরা সচেতন হচ্ছি না।
রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন যুগান্তরকে বলেন, খোঁজ নিলে দেখা যায় বাসা-বাড়িসহ যেখানে-সেখানে পানি জমে থাকছে। সামান্য পরিমাণ জমা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে। লার্ভা জন্ম নেয়। আবার এমন কিছু জায়গায় এডিস মশা প্রজনন করছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স। এছাড়া পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, বাজারঘাট, উচ্চ ভবনের ছাদে ফেলে রাখা পরিত্যক্ত আসবাবপত্র, দুই ভবনের মাঝখানের খালি জায়গা, সরকারি দপ্তরের পরিত্যক্ত গাড়ি ও বস্তি এলাকা ইত্যাদি। সবখানে মশা নিধন কার্যক্রমে নিয়োজিত স্টেকহোল্ডাররা পৌঁছাতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশা হলো ভেক্টর আর ডেঙ্গু ভাইরাস হলো রোগের জীবাণু। মানুষ হলো এই রোগের আশ্রয়দাতা বা হোস্ট। বছরজুড়েই এডিস মশা মানুষের বসতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। মশার বংশবিস্তার হলে আক্রান্ত বাড়বে। সেই সঙ্গে মৃত্যু বেশি হবে। কিন্তু কার্যক্রম ভাটায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ফলে বছরজুড়ে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাত থেমে যাওয়ার দেড় থেকে ২ মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু থাকবে। যেহেতু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টি ছিল, সঙ্গে তাপমাত্রাও বাড়তি ছিল। ওই সময় যেসব মশা ডিম পেড়েছে সেগুলোই বড় হয়ে ডেঙ্গু রোগী থেকে ভাইরাস শরীরে নিয়ে এখন সুস্থ মানুষকে কামড়াচ্ছে। এ কারণেই অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। বৃষ্টিপাত না হলে আশা করা যায় ডিসেম্বরের শেষদিকে রোগী কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যথাযথ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার অভাবে মশক নামক ছোট্ট কীটটি কতটা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। মশার ভেতর বেড়ে উঠা ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পরিবর্তিত শরীরে কত স্বাচ্ছন্দ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে শক্তিশালী হয়ে জানান দিচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে এখনই মশা ও ভাইরাসের প্রতিরোধী মাত্রা নির্ণয় করে উপযোগী কীটনাশক ও বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর।