হিলি থেকে ৩ মাইল দূরের ছাতনী গ্রামে ঘাঁটি গাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। এখানে অবস্থান নেয় এ বাহিনীর প্রায় ৭ হাজার সেনা। এদের সঙ্গে ছিল ৪০টি ট্যাংক। তবু তারা ছাতনী গ্রামের মুহাড়া পাড়ায় খাল কেটে বেশ কয়েকটি বাংকারও বসায়। প্রথম দিকে এমন ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কেবল স্থলপথে হামলা চালিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা। তাই ১০ ডিসেম্বর থেকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা আকাশপথেও হামলা চালাতে শুরু করেন। এতে কাজ হয়। দুই দিনের মাথায় পিছু হাঁটা শুরু করে হানাদাররা।

১১ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় দিনাজপুরের হিলি। এ দিনের আগে-পরের গল্প বলতে গিয়ে কথাগুলো জানালেন হাকিমপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. লিয়াকত আলী। তিনি আরও জানালেন, ৭নং সেক্টরের অধীন হিলিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ১১ ডিসেম্বরের আগেও অনেকবার যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী মানুষদের।
মো. লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, হিলিকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর ১৩শ’ জন সদস্য ও মিত্রবাহিনীর ৩৪৫ জন সদস্য শহীদ হন। এদিকে, ‘দেশের সর্ববৃহৎ এই সম্মুখযুদ্ধে’ প্রায় সাত হাজার পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামের মোস্তফা, একরাম উদ্দিন, বানিয়াল গ্রামের মুজিব উদ্দিন শেখ, ইসমাইলপুর গ্রামের মনিরুদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন, বৈগ্রামের ইয়াদ আলী ও চেংগ্রামের ওয়াসিম উদ্দিনসহ এ অঞ্চলের আরও অনেক দামাল শহীদ হন।
হাকিমপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থায় হাকিমপুর তথা হিলি এলাকার নেতারা খলিলুর রহমান ও ডা. আবুল কাশেমকে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেন। এতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, আনসারদের সমন্বয়ে বাংলা হিলি বালিকা বিদ্যালয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা হয়।
জয়নাল আবেদীন আরও জানান, পাকিস্তানি বাহিনী যাতে হাকিমপুরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ২৫ মার্চের পর হাকিমপুরের প্রবেশপথগুলোতে গাছ কেটে ফেলে রাখেন সেচ্ছাসেবক কমিটির সদস্যরা। একইসঙ্গে তারা কোনও কোনও সড়কে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে রাখেন। পরে একদিন থানা ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প থেকে সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের হাতে ৩০৩টি রাইফেল তুলে দেওয়া হয়।
জয়নাল আবেদীন জানান, এদিকে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর নিজাম উদ্দিন ১৭টি গাড়িবহরসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফুলবাড়িতে এসে অবস্থান নেয়। একইসময় হিলি ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার শুকুর আলীর নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কয়েকজন ইপিআরকে বিহারি অধ্যুষিত পার্বতীপুরের হাবড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের জন্য পাঠানো হয়। এতে সেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। ওই সময় বিভিন্ন ধরনের গোলার আঘাতে স্বেচ্ছাসেবক দলের ৯ জন যোদ্ধা শহীদ হন।

মো. লিয়াকত আলী ও জয়নাল আবেদীন জানান, একদিন হঠাৎ মেজর নিজামের মৃত্যু হয়। এর কয়েক দিন পর ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলবলসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হিলিতে এসে অবস্থান নেন এবং পাকিস্থানি বাহিনীর হাত থেকে এ এলাকাকে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে, ১৯ এপ্রিল ঘোড়াঘাট ও পাঁচবিবির দিক থেকে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করতে করতে পাকিস্তানি সেনারা হিলিতে আক্রমণ করে। ১৯, ২০ ও ২১ এপ্রিল হিলিতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের দলের দুই জন শহীদ হন। পরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার তার দলবলসহ ভারতের বালুরঘাটের তিওড়ে অবস্থান নেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত করে পতিরামে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠান। এদিকে, বালুরঘাটের কুমারপাড়ার কুড়মাইল ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইদের নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। এসব যুদ্ধের মাধ্যমেই ১১ ডিসেম্বর বেলা ১টার দিকে হিলি হানাদার মুক্ত হয়।
মো. লিয়াকত আলী জানান, মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছর পর মুহাড়াপাড়া এলাকায় স্মৃতিস্তম্ভ ‘সম্মুখ সমর’ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ফলকে শহীদদের নাম না থাকায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মৃতি রক্ষার্থে হিলি সীমান্তের শূন্যরেখার পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণেরও তিনি দাবি জানান।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন শোভাযাত্রা, পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া-মাহফিল ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews