কামরুল হাসান দর্পণ : শিক্ষা জাতির মেরুদ-। এ দ- দৃঢ় না হলে, জাতির ভবিষ্যৎও দুর্বল হয়ে পড়ে। বিগত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর ফলাফল হচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে। ধারাবাহিকভাবে গড় পাসের হার শতকরা ৯০ ভাগের উপরে। এ বছর পাসের হার কিছুটা কম হয়েছে। সার্বিক পাসের হার শতকরা ৮৭.০৪। গত বছর ছিল শতকরা ৯১.৩৪ ভাগ। কমেছে শতকরা ৪.৩ ভাগ। এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বেশ একটা আক্ষেপ প্রকাশ করতে দেখে গেছে। পাসের হার কমার জন্য রাজনীতিকে টেনে আনা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় খারাপ ফলাফলের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরীক্ষার সময় বিএনপি-জামায়াতের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালকে দায়ী করেছেন। শিক্ষাবিদরা রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি গণিতে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল হওয়ার বিষয়টিকেও দায়ী করেছেন। গত বছরের তুলনায় পাসের হারের মধ্যে সামান্য ফারাক নিয়ে বলা যায়, এক ধরনের দোষারোপ করা হয়েছে। অবশ্য শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি অবরোধ-হরতালের নেতিবাচক প্রভাবের কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো গণিত ও উচ্চতর গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র চালু করা হয়। যে কোনো পদ্ধতি প্রথম প্রথম একটু কমই বোধগম্য হয়। আর আমি বলে দিয়েছি, যে বা যারা উদারভাবে খাতা দেখা বা নম্বর দেয়ার কথা বলবে, তাদের তথ্য দেবেন। সংশ্লিষ্টদের আমরা চিহ্নিত করব। হয়তো এরও কোনো প্রভাব পড়তে পারে।’ শিক্ষা সচিবের কথা থেকে মনে হতে পারে, বিগত বছরগুলোতে উদারভাবে পরীক্ষার খাতা দেখা হয়েছে। যে কারণে পাসের হার এত বেশি ছিল। আর এ বছর তিনি উদারভাবে খাতা না দেখতে বলে দেয়ায় পাসের হার একটু কম হয়েছে। এ থেকে শিক্ষার মানের বিষয়টি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। অথচ সত্তর-আশির দশকে এমনকি নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখা যেত এসএসসি পাসের গড় হার শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। শতকরা সত্তর ভাগ শিক্ষার্থীই ফেল করত। এখন কোন কোন স্কুলে একশ’ ভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থী পাস করছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এ দশকের তুলনায় আগের দশকের পাসের হার কেন এত কম ছিল, এখন কেনইবা এত বেশি? সেসময় কি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কম ছিল? নাকি এক দশকের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা মেধার অত্যুঙ্গে উঠে গেল? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। যারা সেসময়ে ২৪-২৫ পাসের হারের মধ্যে পাস করে সরকারি-বেসরকারি বড় বড় পদে চাকরি করছেন, তাদের এক ধরনের মতামত থাকতে পারে। আবার যারা এ সময়ে ৯০ ভাগ পাসের হারের মধ্যে পাস করেছে বা করছে, তাদের এক ধরনের মত থাকতে পারে। তবে সে সময়ের শিক্ষা পদ্ধতি এবং এ সময়ের শিক্ষা পদ্ধতির পার্থক্য নিয়ে তারা একমত হবেন। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, এ নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। সেসময় যেসব ছাত্র-ছাত্রী স্ট্যান্ড করতো বা মেধা তালিকায় এক থেকে বিশের মধ্যে থাকত, তাদের আদর-কদর সর্বত্রই ছিল। নামীদামি কলেজগুলোতে তাদের ভর্তি করে নেয়ার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা ছিল এবং স্ট্যান্ড করা কোন ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করাতে পারলে গৌরববোধ করত। এ দশকে এসে প্রায় স্ট্যান্ড করার সমতুল্য জিপিএ-৫-এর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৩১৩। এবার তা কিছুটা নেমে হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১। দুঃখের বিষয়, এ বছর যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের অনেকেই কক্সিক্ষত ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬২ হাজার শিক্ষার্থী মানসম্মত কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এটা কি ভাবা যায়, স্ট্যান্ড করার সমতুল্য জিপিএ-৫ প্রাপ্ত প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না! তাদের নিয়ে মানসম্পন্ন কোনো কলেজ ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না! এতে কি প্রমাণিত হয় না, জিপিএ-৫ পাওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উক্ত ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে না? তারা যে শিক্ষা গ্রহণ করছে, তার মান ভর্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?॥ দুই ॥মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার সহজ করে দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। বিগত কয়েক বছর ধরে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পাশের হার দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এ দায়িত্ব পালনে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করছে। তবে পাসের হার বৃদ্ধির সাথে শিক্ষার গুণগত মান কতটা সংরক্ষিত হচ্ছে, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। ইতোমধ্যে প্রশ্নও উঠেছে। অনেকে সরকারের সমালোচনা করে বলেন, সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে তার ব্যাপক সাফল্য দেখানোর জন্য পাসের হার বেশি বেশি করে দেখাচ্ছে। সমালোচকরা এ বিতর্ক করতেই পারেন। তাদের এ বিতর্ক যে একেবারে অনর্থক, তা সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বিগত বছরগুলোতে যেভাবে হয়েছে এবং হচ্ছে, তা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এ ফাঁসের সাথে কারা জড়িত তা নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। এখন এ অভিযোগ নামী স্কুলের একশ্রেণীর শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠেছে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন) প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর তা সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া, সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়া ও পছন্দের কেন্দ্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের আসন ব্যবস্থা করার মতো অভিযোগের সত্যতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা পেয়েছেন। জিপিএ-৫সহ পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বোর্ডের সেরাদের তালিকায় স্থান করে দিতেই একশ্রেণীর শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অপরাধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন স্তরে অবস্থান করছে, তা এসব ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। অর্থাৎ শিক্ষাকে পুরোপুরি পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। এটা এখন আর মানুষের স্বাভাবিক অধিকারের মধ্যে নেই। কেউ চাইলেই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও পড়াশোনা করতে পারে না। ফলাফলের দিক থেকে সেরা স্কুলের স্বীকৃতি পাওয়ার এই অশুভ প্রবণতার পেছনেই শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার অভিপ্রায় রয়েছে। যে স্কুলটি সেরা দশ বা বিশের মধ্যে থাকবে, স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সেই স্কুলের দিকে ধাবিত হবে। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তকমা লাগানো প্রতিষ্ঠানগুলোও এ সুযোগে ভর্তির সময় মোটা অঙ্কের অর্থ ধার্য থেকে শুরু করে ডোনেশনের নামে অভিভাবকদের জিম্মি করে ফেলছে। অভিভাবকরাও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে যত কষ্টই হোক, তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের কিছুই করার থাকে না। ভর্তির পর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি ধরনের পড়াশোনা হয়, তা ভুক্তভোগী অভিভাবক ছাড়া আর কেউই জানে না। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন অভিভাবক যাদের সন্তান রাজধানীর অত্যন্ত নামী স্কুল থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে। এক অভিভাবক বলেন, ক্লাস নাইন থেকে একটানা দুই বছর মেয়েকে কোচিং করিয়েছি। প্রতিমাসে শুধু এ জন্য খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মেয়ের এই সাফল্যের কৃতিত্ব স্কুলের নয়, আমাদের। তিনি বলেছেন, আমার সামর্থ্য ছিল বলে মেয়ে ভালো ফল করেছে। যেসব অভিভাবকের নেই, তাদের কত কষ্ট হচ্ছে! স্কুলগুলো যদি যতœবান হতো, তাহলে কোচিং করানোর প্রয়োজন হতো না। আরেক অভিভাবক বলেছেন, শুধু কোচিংয়ের খরচই নয়, মডেল টেস্টসহ আরও কত যে খরচ করেছি, তার হিসাব নেই। কৃতিত্ব যদি নিতে হয়, সেটি আমি আর আমার স্ত্রী নেব। স্কুলে নামমাত্র পড়িয়েছি। এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আরেক অভিভাবক বলেছেন, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলের পেছনে সময় দিতে হয়েছে। স্কুলের অবদান আমাদের থেকে খুবই কম। অভিভাবকদের এসব প্রতিক্রিয়া থেকে এটাই প্রতীয়মাণ হয়, কথিত ভালো স্কুলগুলো ক্লাসের চেয়ে শিক্ষার্থীদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে কোচিং করানোর দিকেই বেশি মনোযোগী। কেউ যদি বলে স্কুলগুলো কোচিং সেন্টারের হেড কোয়ার্টারে পরিণত হয়েছে, তাহলে তাদের কি দোষ দেয়া যাবে? আর অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে একটি ভালো স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থেকে পরীক্ষা দিতে হবে বলে, তারা সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। স্কুলের যেন কোন দায়িত্ব নেই, সব দায়দায়িত্ব অভিভাবকের। এই স্কুলগুলোই অনেকটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেরা স্কুলের তালিকায় ঠাঁই পেতে নানা অনৈতিক কর্মকা- করে চলেছে। কোচিংকে অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করেছে। এমনও শোনা যায়, একটি কথিত ভালো স্কুলের একজন শিক্ষক নিজ বাসায় ব্যাচ বা কোচিং করিয়ে মাসে দুই-তিন লাখ টাকা আয় করেন। যে ছাত্র বা ছাত্রী কোচিং করবে না, ক্লাসে সে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে এবং যত ভালো পরীক্ষা দিক না কেন, তার রেজাল্ট ভালো হবে না। নামীদামি অধিকাংশ স্কুলে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। সংশ্লিষ্ট অভিভাবকমাত্রই বিষয়গুলো জানেন। কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেও লাভ নেই। বাধ্য হয়ে সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তাদের মেনে নিতে হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কেউ চাইলেই ভালো স্কুলে ভর্তি বা পড়াশোনা করতে পারছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের এসব স্কুলে পড়ার অধিকার নেই। সাংবিধানিক অধিকার শিক্ষা এখন আর সহজ নয় এবং গুণগত শিক্ষা পেতে হলে শিক্ষাকে কিনে নিতে হবে। ॥ তিন ॥প্রতিবছর ভালো ফলাফল করা সেরা ২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করা হয়। আগামী বছর থেকে এ তালিকা ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। দেখা গেছে, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেরা ১০ বা ২০ তালিকায় থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তির জন্য অভিভাবকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যে কোন উপায়ে ভর্তি করানোর প্রচেষ্টা চালান। এই সুযোগে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। ডোনেশনসহ উচ্চ হারে নানা ধরনের চার্জ আদায় করে। অভিযোগ রয়েছে, স্কুলের ফলাফল ভালো করার জন্য এসব স্কুলের একশ্রেণীর শিক্ষক পরীক্ষার দুই-তিন ঘণ্টা আগে প্রশ্নের প্যাকেট খুলে এমসিকিউ সমাধান করে নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয়। এতে সহজেই শিক্ষার্থীরা ৪০ নম্বর পেয়ে যায়। এ পদ্ধতিও তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ নিয়ে কারো কারো দ্বিমত থাকলেও অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন। একজন শিক্ষাবিদ বলেছেন, এমসিকিউ চিন্তাশক্তির বিকাশ করে না, এটা তুলে দেয়ার জন্য আমরা অনেক আগেই বলেছি। তখন মন্ত্রণালয় এর পক্ষে বলেছে। এখন প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে না পেরে এটা তুলে দেয়ার চিন্তা করছে। তারপরও এটা বন্ধের সিদ্ধান্তটি ভালো। সেরা ২০ তুলে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, উচিত ছিল সেরা ২০-এ ঢুকতে যেসব প্রতিষ্ঠান অনৈতিক কাজে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এসব ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, শিক্ষা পদ্ধতি বদলেছে ঠিকই, এ পদ্ধতি প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। যেমন সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর আগে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। বিষয়টি অনেকটা অ্যানালগ থেকে সরাসরি ডিজিটালে ঢুকিয়ে দেয়া বা বাসচালককে এরোপ্লেন চালাতে দেয়ার মতো ঘটনা। যদি শিক্ষকদের আগে থেকেই নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তা প্রবর্তন করা হতো, তবে শিক্ষার্থীদেরও কোন সমস্যায় পড়তে হতো না। এবার যেমন গণিতের ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু নিয়ে গোল বেঁধেছে। ফলাফলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণ হিসেবেও সৃজনশীল পদ্ধতিকে দায়ী করা হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, গণিত নিজেই সৃজনশীল। এটিকে আবার সৃজনশীল ও নৈর্ব্যক্তিকÑ এই দুই অংশে বিভক্ত করা হয়েছে এবং দুই অংশেই পাস করতে হয়। আলাদাভাবে পাস করার বিধান থাকায় শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে খারাপ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী নতুন এ পদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি বা শিক্ষকরা তাদের সঠিকভাবে বোঝাতে পারেনি।পাসের হার বৃদ্ধি যে শিক্ষার মান বৃদ্ধি নয়, এটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। যেখানে এসএসসি ও এইচএসসিতে সাবর্চ্চে গ্রেড নম্বর পেয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সেখানে গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর পায়নি। বিষয়টি খুবই আশঙ্কাজনক। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় অংশ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সারা দেশ থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল করে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী মনে করা হয়, তাদের। দেশের সর্বোচ্চ ফলাফলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মেধাবী এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। ভালো ফলাফলের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান যে বাড়ছে না, তা নিশ্চিত। আবার যারা ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে, তাদের অনেকেই অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। বলা বাহুল্য, শিক্ষার চলমান এই চিত্র গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারছে না।॥ চার ॥বাংলাদেশে কোন স্তরেই যে শিক্ষার গুণগত মান সন্তোষজনক নয়, তা নিয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষাবিদরা অনেক কথা বলেছেন। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার এখন শতভাগের কাছাকাছি এসে পড়েছে। গত কয়েক বছরের ফলাফলের চিত্র বলে দিচ্ছে, আগামী দুটি পরীক্ষার পরই হয়ত কোন শিক্ষার্থী ফেল করবে না। তবে সংখ্যাগত সূচকে মেধার বিস্ফোরণ ঘটলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে শিক্ষার মান। গুণগত মানোয়ন্ননের বিষয়টি বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে বিশ্বব্যাংক গত বছর এক রিপোর্টে বলেছে, ভর্তির হার বাড়লেও কমছে শিক্ষার মান। এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের কোন তালিকাতেই নেই। এর অর্থ বাংলাদেশের শিক্ষার মান বিশ্বের কোথাও স্বীকৃতি পাচ্ছে না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। অথচ আমরা কেবল প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের কোয়ান্টিটি বাড়িয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, কোয়ালিটি যে তলানিতে রয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল করছি না। একজন ছাত্র ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে কোথাও চাকরি পেল না, তার মানসিক অবস্থা কি হতে পারে, এ দিকটি চিন্তা করছি না। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের উদ্যোগ না নিয়ে কেবল পাসের হার বৃদ্ধি করে প্রকারন্তরে আমরা কি একটি হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি করছি না? তরুণ প্রজন্মকে এই হতাশা থেকে মুক্তি ও প্রকৃত অর্থে মেধাবী করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির বিকল্প নেই। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান ও সকল পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করা জরুরি। সংখ্যা নয়, মানের মাধ্যমে যাতে শিক্ষার্থীর পাসের হার বৃদ্ধি পায়, এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা অপরিহার্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোচিং বাণিজ্যসহ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। নতুন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদন দেয়া যাবে না। যারা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে পিএসসির আদলে আলাদা শিক্ষা কর্ম কমিশন করে সরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষককে, উপযুক্ত বেতন দিতে হবে। তা নাহলে মেধাবীরা এ পেশায় আগ্রহী হবে না। darpan.journalist@gmail.com


Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews