বাংলাদেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশই হচ্ছে তরুণ-তরুণী। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদানই আগামী দিনে আমাদের ভরসা, বিশেষত যখন চীনসহ কিছু দেশে বুড়ো লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু যদি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কর্মবিমুখতা দেখা দেয় তাহলে কী হবে? যদি তাদের মধ্যে বেকারত্ব থাকে তাহলে কী হবে? অথচ দেখা যাচ্ছে, এমন একটা অবস্থার মধ্যেই আমরা পড়তে যাচ্ছি।

‘বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)’ সম্প্রতি একটা গবেষণা করে তার ফল প্রকাশ করেছে। একটি দৈনিক এর ওপর স্টোরি করতে গিয়ে শিরোনাম করেছে : ‘রেমিটেন্স গ্রহণকারী পরিবারের তরুণরা বেশি কর্মবিমুখ।’খবরের ভেতরে বলা হচ্ছে : ‘কৃষিপ্রধান পরিবারগুলোর চেয়ে বৈদেশিক রেমিটেন্স গ্রহণকারী পরিবারের তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব এবং কর্মহীনতার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। তা ছাড়া প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ফলে গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।’ আরও বলা হচ্ছে : ‘দেশে তরুণদের মাঝে আত্মকর্মসংস্থানের চেয়ে বেতননির্ভর চাকরি গ্রহণের প্রবণতা বেশি। গ্রামীণ মুসলিম পরিবারের নারীদের শ্রমখাতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা কম। ...সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলের নারীদের কর্মে নিয়োগের হার তুলনামূলকভাবে কম লক্ষ করা যাচ্ছে।’সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলা হয়নি। তবে যেটুকু বলা হয়েছে তাই যথেষ্ট। দেশের কম করে হলেও এক কোটি, সোয়া কোটি মানুষ বিদেশে চাকরি করে এবং তারা নিয়মিত ডলার পাঠায়। এই ডলার আমাদের অর্থনীতির ‘প্রাণভোমরা’ এবং গ্রামীণ মানুষের মধ্যে একটা বিরাট সংখ্যকের জন্য এটা ক্রয়ক্ষমতা জোগায়। বলা বাহুল্য এই ডলার এবং রফতানি আয়ের ডলার আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করে রেখেছে; কিন্তু এই চাঙ্গাভাবের মধ্যে যদি ‘শত্রু’ লুকিয়ে থাকে তাহলে তো সমূহ বিপদ। রেমিটেন্স যদি রেমিটেন্স প্রাপকের পরিবারের তরুণদের কর্মবিমুখ করে তোলে তাহলে তো তা পরিণামে বিপদ ডেকে আনবে। যদি তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে কর্মবিমুখ হয় এবং বেকারত্ব বরণ করে তাহলে রেমিট্যান্সের সুবিধা তো বিপদে পরিণত হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বর্তমান প্রবণতাকে বিপজ্জনক মনে হয়। এ ধরনের একটা বিপদের আলামত পাওয়া যাচ্ছিল; কিন্তু তা স্পষ্ট হচ্ছিল না।দুই-তিন বছর আগের ঘটনা। কিশোরগঞ্জের একটা অঞ্চলে গিয়েছি, বলা যায় বেড়াতেই। ঘটনাক্রমে ওই অঞ্চলের বেশ অনেক লোক বিদেশে কাজ করে। তারা নিয়মিত ডলার পাঠায়। এতে কিশোরগঞ্জের উন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬’তে দেখলাম কিশোরগঞ্জ জেলা দেশের অন্যতম দরিদ্রতম অঞ্চল। সেখানকার ৬০-৬৫ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে। তার স্থান লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলার মতো। এহেন কিশোরগঞ্জের এক গ্রামের রেমিটেন্স প্রাপক এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সদ্যপ্রয়াত তার নাম ধনু মিঞা। দেখলাম তার মেয়ে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট চেনে। তার যুবক ছেলে ‘এসএসসি’ পাস করে বসে আছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সে কলেজে যায় না, পড়াশোনাও করে না। কোনো কাজও করে না। সে দুই বছর ধরে চেষ্টা করছে সৌদি আরব যাবে যেখানে তার বড় ভাই কাজ করে। তার বর্তমান কাজ হচ্ছ পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাজারে দিনরাত আড্ডা মারা। নাস্তা ওই বাজারেই করে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে সে টেলিভিশন দেখে। বাপের কথা শোনে না। এসবই ধনু মিয়ার কথা। পুরো গ্রামের তরুণদের স্বপ্ন কীভাবে তারা বিদেশ যাবে। দালালের পেছনে তারা ঘোরে। টাকা নষ্ট করে অনেকেই। জমিতে যায় না তারা। বস্তুত তারা কর্মহীন, আয়-রোজগারহীন। তাদের অনেকের ছোট-বড় ভাই বিদেশে থাকে। অতএব ভালো আয় আছে মাসিক। তারা বাড়ি পাক্কা করে। কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে ভাড়া দেয়, বিদ্যুতের যন্ত্র ভাড়া দেয়। রোজগার ভালো। কেউ শ্রমের কাজ করে না। গ্রামীণ ‘আড্ডা’ তাদের খুবই প্রিয়। একটু লেখাপড়া করলেই বেতনের চাকরি খোঁজে। নিজে কিছু করতে রাজি নয়। অনেকের সঙ্গে কথা বলে এসব জেনেছি। বাড়ির মেয়েরা বাড়ি থেকে বেরোয় না। যখন এসব জেনেছি তখন ভেবেছি হয়তো এটা একটা এলাকার বিষয়, দেশের নয়। কর্মবিমুখতা, মেয়েদের কর্মবিমুখতা, চাকরিপ্রিয়তা হয়তো দেশের সর্বত্র নেই। কিন্তু এখন ‘বিআইডিএস’-এর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এটা দেশময় একটা ঘটনা। যদি তাই হয় তাহলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কোত্থেকে আসবে? দেশের বেশি বেশি লোক বুড়ো হলে কাজ করার মতো লোক পাওয়া যায় না। উল্টো বরং তাদের পুষতে হয়, চিকিৎসা করাতে হয়, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এতে প্রচুর খরচ। এ অসুবিধায় ইউরোপের দেশগুলো ভুগছে, আমেরিকা ভুগছে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভুগছে। চীনে একই সমস্যা। যেখানে গড় আয়ু ৮০-এর মতো। জাপানে ৮৯। কাজের লোক কোথায়? সেই কারণে তারা বিদেশে লোক নিচ্ছে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করাতে, দোকান চালাতে, পেট্রোল স্টেশনে তেল ঢালতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের ধারণা ছিল আমরা তরুণ জাতি। আমাদের দেশে ৬০ প্লাস লোকের সংখ্যা এক কোটি দশ-বিশ লাখের মতো। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭-৮ শতাংশ। অতএব এ বিপুল তরুণ সস্তায় কাজ করবে। আমাদের মালের দাম হবে সস্তা। বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমাদের কেউ হারাতে পারবে না। বিপরীতে বুড়োদের পালতে খরচ হবে না ততো, যদিও অবসরপ্রাপ্তদের পালতে এখনই দিন দিন খরচ বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই অবসরপ্রাপ্তদের পেছনে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এটা খুব বেশি নয়। সহ্যসীমার মধ্যে। অতএব আশা ছিল তরুণরা আমাদের ভরসা। এখন তারা যদি কর্মবিমুখ হয়, রেমিটেন্স প্রাপকের পরিবারের মেয়েরা যদি পর্দানশীন থাকতে চান, আর সবাই চায় চাকরি তাহলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে?শুধু ‘রেমিট্যাস প্রাপকের’ পরিবারেরই এ অবস্থা নয়, অন্যান্য কৃষক পবিবারের অবস্থাও তাই। আগের গ্রাম আর নেই। তথাকথিত স্কুল, কলেজে গ্রাম আজকাল ভর্তি, যেখানে ব্যাকরণ, ইংরেজি, বিজ্ঞান, অঙ্ক পড়ানোর কোনো শিক্ষক নেই। অথচ সেখান থেকে কোনোমতে একটা ডিগ্রি নিয়েই তারা চাকরি চায়, বেতনের চাকরি চায়। কৃষিতে কেউ যুক্ত হতে চায় না। এটা খুবই ভাবার বিষয়। পাঁচ-সাত-দশ বিঘা জমির মালিকদের ছেলেমেয়েরা যেমন কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না, তেমনি ভূমিহীন চাষীর ছেলেমেয়েরাও কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না। সবাই চাকরি চায়। চাকরি তাই সোনার হরিণ। চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন চুরি হয়, মৌখিক পরীক্ষায় কারচুপি হয়। চাকরি বিক্রি হয় পাঁচ-দশ-বিশ লাখ টাকায়। চাকরি চাই সবার। এ এক উন্মত্ততা। চাকরি না পাওয়া ছেলেরা গ্রামাঞ্চলে ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল হচ্ছে। ধর্মের নামে অধর্ম শিক্ষা, ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন, ক্রিকেট খেলা ইত্যাদি এসব ছেলেমেয়েকে এক অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। ফেনসিডিল, মাদক, দেশি মদ ইত্যাদি গ্রামে গ্রামে পাওয়া যায়। রাজনীতির নামে একশ্রেণীর যুবক গ্রামগুলোকে করে তুলেছে নরক হিসেবে। জমিজমা দখল, নদী দখল, মেয়েদের উৎপাত করা, চাঁদাবাজি করা তাদের কাজ। ‘রেন্ট সিকিং’ তাদের পেশা। পরের ধন হরণ করাই তাদের কাজ। এসব করলে ‘কাজে’ ব্যস্ত হতে হয় না। কর্মবিমুখ তো হবেই। আবার কর্মবিমুখ হওয়ার জন্য কারণও আছে। গ্রামের অর্থনীতিতে জড়িত হতে গেলে সেই ধরনের শিক্ষা লাগে। সব বিএ, এমএ পাস ছেলেমেয়ে। এ ডিগ্রির কী মূল্য? এ ডিগ্রি দিয়ে কি চাকরি হয়? দরকার ছিল ‘টেকনিক্যাল’ শিক্ষা যাতে নিজের কাজ নিজে করতে পারে। কিছু পুঁজির দরকার তা ব্যাংক দিতে পারে। বড় বড় কাজ ‘স্টার্টআপ’ তো বড়দের জন্য। গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য দরকার অল্প পুঁজি। তা তো ব্যাংকগুলো দেয় না। তারা খোঁজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কেউ তাদের বলে না নিজের কাজ করতে। গার্জিয়ানরাও চায় চাকরি। এতে সুবিধা অনেক। কোনোমতে চাকরির উচ্চশিখরে পৌঁছাতে পারলে পূর্বাচলে ৫-১০ কাঠা জমি, যার দাম ৫-১০ কোটি টাকা। এটা না হলেও ক্ষতি নেই। অফিসে গেলেও বেতন, না গেলেও বেতন। চাকরি যাওয়ার আশংকা নেই। তবে বেসরকারি খাতের চাকরির এখন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা আজ আছে কাল নেই। বেসরকারি খাতের মালিকরা এখন ধীরে ধীরে ‘ট্রাম্পের’ শিষ্য হচ্ছে। মুনাফাই হচ্ছে একমাত্র লক্ষ্য। এ অবস্থায় প্রশ্ন ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের’ কী হবে? যদি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের প্রশ্ন হিসেবে নিই তাহলে তো আরও বিপদ। অতএব চিন্তা করা দরকার এখন থেকেই। কর্মবিমুখতা দূর করার ব্যবস্থা করা দরকার।ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews