গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলা চালিয়ে মুসল্লিদের হত্যার ঘটনার পেছনে গভীর রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, অ্যাংলো-মার্কিন কর্তৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ৩০ বছর ধরে মুসলিম দেশগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ মুসলিম বাস্তুচ্যুত হয়েছে, শরণার্থী হয়েছে। বলা হচ্ছে, মুসলিমরা গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসী হুমকির উৎস। ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে তাদের।
পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামবিদ্বেষ গণহারে ছড়িয়েছে। অন্য সব বিদ্বেষমূলক অপরাধের চেয়েও এর মাত্রা অনেক বেশি। ইহুদি-খ্রিস্টীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি মহামারির মতো ছড়িয়েছে। পশ্চিমা ও ইসরায়েলি রাজনীতিকরা খুবই কড়া অভিবাসননীতি গ্রহণ করছে। কোনো কোনো দেশে মুসলিম অভিবাসন-প্রত্যাশীদের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ইসরায়েল আরেক কাঠি সরেস, তারা মুসলিম আদি অধিবাসীদের বাস্তুচ্যুত করেছে। নিউজিল্যান্ডের ওই খুনির ওপর পশ্চিমা ও ইসরায়েলি ভাবাদর্শের প্রভাব স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব পশ্চিমা সরকার ফ্যাসিবাদী চরমপন্থী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী (হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট) বদমাশদের মেনে নেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এ সুযোগে বদমাশরা অবাধে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে এবং কর্মকাণ্ড করছে। মুসলিমবিরোধী অধিকাংশ প্রচারণা টুইটার-জাতীয় সামাজিক গণমাধ্যমে চালানো হয়।
তৃতীয়ত, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পুলিশ মুসলিমদের ব্যাপারে, আইন-অনুসারী সাধারণ নাগরিকদের ব্যাপারে খবর রাখলে ও নজরদারি করলেও স্বঘোষিত খুনি ও মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারকদের খবর রাখতে ব্যর্থ। খুনি ব্রেন্টন টারান্টের ব্যাপারে কোনো নথি রাখেনি নিউজিল্যান্ডের পুলিশ ও সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স। তার ওপর নজরও রাখেনি। অথচ সে প্রকাশ্যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী নেতাদের প্রতি, যেমন নরওয়ের অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের প্রতি তার অনুরাগের কথা জানিয়েছে।
টারান্ট ৭৪ পৃষ্ঠার একটি মুসলিমবিদ্বেষী ম্যানিফেস্টো প্রচার করেছে। যার কম্পিউটার আছে, সে সহজেই তা দেখতে-পড়তে পারবে। এর জন্য ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে চাকরি করা জরুরি নয়। কয়েক মাস আগেই সে হামলার পরিকল্পনা করেছে, অথচ কোনো ওয়াচলিস্টে তার প্রসঙ্গ নেই। বন্দুকের লাইসেন্স পেতে বা ডজনখানেক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র পেতে তার সমস্যা হয়নি। বিস্ফোরক জোগাড় করতেও তার সমস্যা হয়নি।
সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে আল নুর মসজিদে। ক্রাইস্টচার্চের ওই জায়গাটি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। অথচ সাড়া দিতে পুলিশের লেগেছে ৩৬ মিনিট। খুনিকে খুন-জখম করার জন্য বেশ সময় দেওয়া হয়েছে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে যাওয়া, অস্ত্রে গুলি ভরে আবার মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের ওপর সব গুলি ছোড়া, অতঃপর লিনউড ইসলামিক সেন্টারে গিয়ে আরেক দফায় মুসল্লিদের খুন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে খুনি। শহরের মেয়র আবার পুলিশের প্রশংসা করেছেন। কারো সন্দেহ হতেই পারে—কর্তৃপক্ষ খুনিকে হামলার সুযোগ দিয়েছে।
পশ্চিমা সরকারগুলো পরিবেশবাদী ও যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদকারীদের বিষয়ে ঠিকই নথি রাখে; অথচ মুসলিমবিরোধী শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের খোঁজ রাখে না। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ পরিচালিত যুদ্ধের কারণে অভিবাসী হতে বাধ্য হওয়া মুসলিমদের ‘আগ্রাসনকারী’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ চালানোর প্রস্তুতি প্রকাশ্যেই নেয় তারা। অথচ তাদের ওপর কোনো নজরদারি নেই।
একজন পুলিশ অফিসারের ওপর গুলি চালানোর পর পাল্টা গুলি চালাতে পুলিশ আধা মিনিটের বেশি সময় নেয়নি; অথচ মসজিদে হামলার পর পাঁচ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে তাদের ৩৬ মিনিট লেগেছে। এটা শুধুই পুলিশের অবহেলা—আমার তা বিশ্বাস হয় না।
যারা হামলার শিকার হলো, সম্ভবত তারা মুসলিম বলেই হামলার শিকার হলো। বেদনা, কান্না, ক্ষোভ, প্রার্থনা—এসবে মুসলিমদের শিকার হওয়ার নিয়তি পাল্টাবে না। শিক্ষামূলক কর্মসূচি তখনই মুসলিমভীতি কমাতে সহায়তা করবে যখন মুসলিম দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। যদি পশ্চিমা নেতারা তথাকথিত ‘মুসলিম আগ্রাসনকারীদের’ ওপর বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ না করে, তাহলেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও তাদের অনুসারীরা দমিত হবে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও শাসকদের মুসলিম দেশে আগ্রাসন ও দখলবাজি বন্ধ হলে, মুসলিমদের বাস্তুচ্যুত করার প্রক্রিয়া বন্ধ হলে তবেই মসজিদে হত্যাকাণ্ড বা কোনো মুসলিমের ওপর হামলা বন্ধ হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সেন্টার ফর
রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশনের গবেষণা সহযোগী
সূত্র : গ্লোবাল রিসার্চ অনলাইন
ভাষান্তর : সাইফুর রহমান তারিক