নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি
নিউজ আপলোড : ঢাকা , শনিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২০
২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দিয়েছিল, তা এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ৯৮ ভাগ এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। দুর্গম চর এলাকা ও পাহাড়ি অঞ্চলের ঘর-বাড়িতেও দ্রুত বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানোর কার্যক্রম চলছে, যা বাস্তবায়ন হলেই শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংবাদকে বলেন, সরকার দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। এখন নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। স্ক্যাডা সিস্টেম, স্মার্ট মিটার, স্মার্ট গ্রিডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় ও আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও গ্রাহকবান্ধব জনবল তৈরির। প্রতিমন্ত্রী বিপু বলেন, যেখানে গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব নয়, সেখানে দেয়া হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ। সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি তা নির্ধারিত সময়ের আগেই পূরণ হবে। আমরা আশা করছি, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যেই গ্রাহকে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা দিতে পারব।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয় চার কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বিদ্যুতের ব্যবহার যত বাড়বে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি তত বেশি হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। গত ১১ বছরে দুই কোটি ৭৬ লাখ নতুন গ্রাহক হয়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে ২৯২ শতাংশ। ২০১৬ সালে সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ যাবে। ইতোমধ্যে দেশের ৯৮ শতাংশ এলাকায় গ্রিড বিদ্যুৎ চলে গেছে। তিন পার্বত্য জেলা ও কিছু চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের কার্যক্রম চলমান, যা আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে।
দেশে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ৬টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। তাদের গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি দুই লাখ। বাকি পাঁচ বিতরণ কোম্পানির অধীনে রয়েছে ৮২ লাখ গ্রাহক। এরমধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) গ্রাহক ১২ লাখ ৪৫ হাজার, ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ১০ লাখ গ্রাহক। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) গ্রাহক ১৪ লাখ। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) দক্ষিণের ২১ জেলার ১৩ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ দিচ্ছে।
সমুদ্র তীরবর্তী দুর্গম চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা। সন্ধ্যা নামলেই হারিকেন বা কুপির আলোতে চলে এ এলাকার মানুষের জীবন। সাবমেরিন কেবল ও সৌর প্যানেলের মাধ্যমে এখানকার দুই লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে আলোকিত করতে যাচ্ছে আরইবি। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে তার আওতাধীন ৯৯ শতাংশ এলাকা বিদ্যুতের আওতায় এনেছে।
আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব.) সংবাদকে বলেন, দেশে মোট ৪৬২টি উপজেলার মধ্যে ৪৬১টিতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলাসহ দেশের হাজারখানেক দুর্গম গ্রাম বাকি রয়েছে। তিন ধাপে এই অফগ্রিড এলাকায় এক হাজার ৫৯টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন করা হবে। জামালপুর, ভোলা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ বেশকিছু জেলায় পড়েছে এসব দুর্গম গ্রাম। এসব গ্রামে বিদ্যুৎ নিতে বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৮৫টি নদী অতিক্রম করতে হবে।
মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব.) আরও বলেন, প্রথম ধাপে ৬৪৬টি গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। এজন্য ৩৫টি স্থানে নদীর তলদেশ দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সাবমেরিন কেবল নিতে হবে। এরপর ওই গ্রামগুলোতে গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এসব গ্রামের এক লাখ ৫৫ হাজার গ্রাহককে চলতি মাসের মধ্যেই গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপের ৩৮৪টি গ্রাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। ৫০টি স্থানে সাবমেরিন কেবল দ্বারা নদী অতিক্রম করে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতায়ন করা হবে। এসব গ্রামের ৯০ হাজার গ্রাহককে নভেম্বরে গ্রিড বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে।
আরইবি চেয়ারম্যান বলেন, অবশিষ্ট ২৯ গ্রাম বেশি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। অধিকাংশ গ্রামেই স্থায়ী জনবসতি নেই। কেবল শুস্ক মৌসুমে বিক্ষিপ্তভাবে মানুষ বসবাস করায় গ্রাহক ঘনত্ব অত্যন্ত কম। এই ২৯ গ্রামের প্রায় ছয় হাজার গ্রাহকের জন্য সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ৩২৬ কোটি টাকার নিজস্ব অর্থায়নের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই কার্যক্রম শেষ হবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পার্বত্য তিন জেলার দুর্গম পাহাড়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করছে। পিডিবি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, যেখানে গ্রিড লাইন নেয়া যাবে না সেখানে সৌরবিদ্যুৎ দেয়া হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৫৬ হাজার গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে আরও ৪০ হাজার পরিবার রয়েছে যাদের এত দুর্গম পাহাড়ে বসতি যে গ্রিড লাইন নেয়া সম্ভব নয়। সেখানে সৌরবিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কার্যক্রম চলমান।
বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত চর। রংপুর ও রাজশাহীর গ্রিড সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম চরে বিনামূল্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করছে নেসকো। এতে ১৩টি চরে বসবাসরত ১২ হাজার ৬৯০টি পরিবার সৌরবিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম সংবাদকে বলেন, পদ্মা ও তিস্তার কিছু দুর্গম চরে গ্রিড সুবিধা পৌঁছানো দুষ্কর। তাই এসব চর এলাকা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলোকিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমে রাজশাহীর চারটি চর-আসাড়িয়াদহ, আলাতুলী, মাজারদিয়া, খিদিরপুরের ছয় হাজার ২৪০টি পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই চারটি চরে এক হাজার ৫৭২টি বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম বসানো হয়েছে। এই প্রকল্পে নেসকোর ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। রংপুরের ৯টি চরে ছয় হাজার ৪৫০টি পরিবারের মধ্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ হবে বলে তিনি জানান।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শফিক উদ্দিন বলেন, গ্রিড সুবিধাবঞ্চিত দক্ষিণের চর মনপুরায় নয় হাজার এবং পটুয়াখালীর কলাতলী আট হাজার গ্রাহককে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সংবাদকে বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যথাসময়ের আগেই তা বাস্তবায়ন করতে চলেছে। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার সবই যথাসময়ে বাস্তবায়ন হবে।
জ্বালানি বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুতের মূল্য গ্রাহকের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখা গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ, যা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হবে। তখন জনগণ নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা পাবে।