• মোস্তাফা জব্বার

চারপাশে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপকভাবে আলোচিত শব্দ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও অনেক নাম যুক্ত থাকলেও বস্তুত সার্বিক বিষয়টি হচ্ছে ডিজিটাল যুগের উপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই দক্ষতার আওতায় পড়বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চব শিল্প বিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ এর দক্ষতাও। অন্যান্য প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও সর্বশেষ আলোচনাটি এখানে তুলে ধরতে পারি। গত ১৩ জুন ১৯ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বাজেট পেশকালে আমাদের অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল খুব স্পষ্ট করে ডিজিটাল যুগের মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণে অকারণে সভায়, সেমিনারে বা রাজনৈতিক আলোচনায় এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লব প্রধান বা মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়। যে দেশ দুনিয়াকে ডিজিটাল দেশের ধারণা দিয়েছে সেই দেশে এমনটি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এটি বোঝা দরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ কেবল চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্প বিপ্লব নয়-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা। এই ধারণা কেবল উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন নয় বা কেবল প্রযুক্তি প্রয়োগের বিষয় নয়, এটি একটি দেশের, একটি জাতির সর্বোচ্চ স্বপ্ন। এই স্বপ্নটাকে সামনে রেখেই আমাদের শিশুদের নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমাদের জন্য ভাবনাটি অতি প্রয়োজনীয় এ জন্য যে আমাদের জনসংখ্যার সমস্ত সম্ভাবনাই আমাদের শিশুদের মাঝে।

যাদের হাত ধরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি দুনিয়া শুনেছে সেই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এখন অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যান্ত্রিক বলে ৫ম শিল্প বিপ্লবের তত্ত্ব প্রকাশ করা হয়েছে যাকে তারা মানবিক বলছে। তাদেরই একাধিক নিবন্ধ পাঠ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম ও তাদের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা হলো। তবে বলে রাখি আমাদের সন্তানদের কেবল ডিজিটাল দক্ষতা দিলেই হবে না ওদেরকে ডিজিটাল বাংলাদেশের দক্ষতাও দিতে হবে। বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুভব করুন যে চতুর্থ/পঞ্চম শিল্প বিপ্লব ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব-কিন্তু আমরা কেবল শিল্পবিপ্লব চাই না, সোনার বাংলা চাই। সোনার বাংলা শিল্প বিপ্লবকে অতিক্রম করার বিষয়। আমি যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি তখন সেই বিশেষ দক্ষতার কথাও বলি। তবে এটিও বুঝতে হবে যে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব আমরা মিস করব না বলে ডিজিটাল দক্ষতা আমাদের অর্জন করতেই হবে-এর পাশাপাশি সোনার বাংলার শক্তিটুকুও অর্জন করতে হবে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম মনে করে, সামনের দশ বছরে বিশ্বের সকল মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ ইন্টারনেটে যুক্তে থাকবে। মনে করা হচ্ছে যে ইন্টারনেট অব থিংসের বদৌলতে বস্তুগত দুনিয়ার সঙ্গে ডিজিটাল দুনিয়া একীভূত হয়ে যাবে। মানুষ তখন টেরই পাবে না যে সে কখন কোন জগতে বাস করছে। সার্বক্ষণিক সংযুক্তি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পৃক্ত হয়ে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করবে যা এর আগে মানবজাতি কখনও অনুভব করেনি। আমরা যারা বয়স্ক মানুষ তাদের জীবনে এই পরিবর্তন কতটা স্পষ্ট করবে সেটি না হয় আলোচিত না হলো, কিন্তু এটা তো ভাবতেই হবে যে আজকের শিশুরাই তেমন একটি দুনিয়াতে বাস করবে। পছন্দ হোক বা না হোক এই বিশ্বে এর বাইরের কোন পছন্দ তার থাকবে না। এমনকি একেবারে দরিদ্রতম পরিবারের শিশুই হোক আর দুর্গমতম স্থানের শিশুই হোক তার জীবন আসন্ন রূপান্তরের মাঝেই প্রবাহিত হবে। ভবিষ্যতের চাকরি বা কর্মসংস্থান নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘By one popular estimate, 65% of children entering primary school today will ultimately end up working in completely nwe job types that dont yet exist. In such a rapidly evolving employment landscape, the ability to anticipate and prepare for future skills requirements, job content and the aggregate effect on employment is increasingly critical for businesses, governments and individuals in order to fully sei“e the opportunities presented by these trends—and to mitigate undesirable outcomes’

অবস্থাটি যদি এমনই হয় তবে তো এখনই আমাদের সময় শিশুদের নিয়ে ভাববার। বাংলাদেশের বর্তমান কর্মসংস্থান চিত্র মোটেই সুখকর নয়। ভবিষ্যত যদি এরকম হয় তবে একটি সুখকর ভবিষ্যত তৈরি করা আমাদেরই দায়িত্ব।

শিশুরা এখনই খুব অল্প বয়সে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং প্রচুর পরিমাণ সময় এই জগতেই কাটাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের হিসাবে পর্দার সামনে থাকে তারা দৈনিক সাত ঘণ্টা। টিভি, কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন এই সময়টা দখল করে রাখে। সম্ভবত তারা এত বিশাল সময় আর কোন কাজে ব্যয় করে না। মা-বাবার সঙ্গে বা স্কুলে এই বিশাল সময় তারা দেয় না। হতাশাজনক হলো এই যে পিতা-মাতারা নিজেরাও জানেন না যে তারা এই সাতঘণ্টা কি নিয়ে কাটায়, কি দেখে, কি শেখে, কার সঙ্গে কথা বলে, কারা বা কোন ধারণা তাদেরকে প্রভাবিত করে। এটি কি বলে দেবার দরকার আছে যে পিতা-মাতা, অভিভাবক-শিক্ষকদের চাইতে এই সাত ঘণ্টার প্রভাব কোনভাবেই কম নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে এই সাত ঘণ্টার প্রভাব অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি হয়। ডিজিটাল দুনিয়ার পরিধি বা ব্যাপকতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ শিক্ষা বা বিনোদন, সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি তার কোনটারই কমতি নেই ডিজিটাল দুনিয়াতে। বস্তুগত দুনিয়াতে যা হাতের কাছে পাওয়া প্রায় অসম্ভব সেটিও হয়তো ডিজিটাল দুনিয়াতে একটি আঙুলের ছোয়া বা একটি মাউস ক্লিকের মতোই কাছে। আমরা যদিও এখনও পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ইন্টারনেটের ততোটা বিস্তার ঘটাতে পারিনি, তবুও বাস্তবতা হচ্ছে সামনের দশ বছরে বাংলাদেশের একটি মানুষ, একটি পরিবার বা একটি বাড়িও ইন্টারনেটের বাইরে থাকবে না। এখন যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তারা হয়তো ভাবতেও পারবেন না যে সেই ইন্টারনেটের গতি কতটা হতে পারে। তারহীন বা স্থির ৫জি ব্রডব্যান্ড সামগ্রিক অবস্থাটি আমূল পাল্টে দেবে। এটিও বেশি বলা হবে না যে মাত্র দুই বছরের মাঝেই আমরা সেই দ্রুতগতির ইন্টারনেটের যুগে পা রাখছি।

এখনই শিশুরা ডিজিটাল দুনিয়ায় হয়রানি, নোংরামি, অশ্লীলতা. সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, মৌলবাদ, অনাকাক্সিক্ষত তথ্য, ম্যালওয়্যার, হিংসাত্মক কর্মকান্ড, অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ, গুজব, ভুল তথ্য ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। ইন্টারনেটের ব্যবস্থাপনা এত দুর্বল যে বস্তুত এর বিকাশ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। এখানে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয়াদি প্রচলিত নয়। অনেক ইন্টারনেট দানব তাদের ইচ্ছামতো উপাত্ত প্রচার ও প্রসার করে থাকে এবং তার প্রথম ভুক্তভোগী হয় শিশুরা।

শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে একটি বড় সমস্যা হলো অভিভাবকরা তাদের পর্যায়ের অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করতে পারে না। একটি বিশাল ফারাক আছে শিশুদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের। মা-বাবা যেমনি তাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না তেমনি শিক্ষক-শিক্ষিকরাও তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। বরং এটি স্বীকার করে নেয়া যায় যে অভিভাবকরা শিশুদের পথ দেখানোর অবস্থাতেই হয়তো থাকে না। অনেকেই জানে না যে শিশুদের ইন্টারনেটের খারাপ দিক থেকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে।

এমন একটি অবস্থায় সকলের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদেরকে ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সহায়তা করা। কেউ কেউ বলছেন শিশুদের আইকিউ যেমন জরুরী তেমনি ডিকিউ বা ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তাও গড়ে তোলা দরকার। এর সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে যে, ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তা হলো ডিজিটাল জীবনধারার চাহিদা পূরণের জন্য এক ধরনের মেধাচর্চা যা কাউকে সামাজিক, আবেগীয়, আমলযোগ্য স্বীকার্য সক্ষমতা। ইংরেজীতে একে বলা হচ্ছে সোসাল, ইমোশনাল এবং কগনিটিভ সক্ষমতা। ডিকিউ ইনস্টিটিউট এর প্রধান নির্বাহী ইউহিয়ান র্পাক ইউহিয়ান ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তাকে মোট আটটি ভাগে ভাগ করেছেন।

ক) ডিজিটাল পরিচিতি : ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার প্রথম দক্ষতাটি হচ্ছে ডিজিটাল পরিচিতি। এটি হচ্ছে কারও সেই যোগ্যতা যার সহায়তায় সে ইন্টারনেটে তার নিজের পরিচিতি তৈরি ও ব্যবস্থাপনা করতে পারে যার সহায়তায় সে তার নিজের পরিচয় ও সুনাম সুরক্ষা করতে পারে। এটি যে কারও জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে কাজটি সাময়িক নয় বরং ইন্টারনেটে একজনের সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতির সার্বিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা।

খ) ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা : ডিজিটাল যন্ত্র তথা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারাটা একটি অতি আবশ্যকীয় সক্ষমতা যা ছাড়া বস্তুত ডিজিটাল দুনিয়াতে টিকে থাকাই অসম্ভব। কাজটি একেবারেই সহজ নয়। ডিজিটাল যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করার পাশাপাশি ইন্টারনেটের জীবন ও ইন্টারনেটের বাইরের জীবনকে সমন্বিত করা এবং দুটির মাঝে ভারসাম্য গড়ে তোলাটা পুরোই চ্যালেঞ্জিং কাজ।

গ) ডিজিটাল সুরক্ষা : ডিজিটাল দুনিয়াতে নিজের জন্য সকল প্রকারের সুরক্ষার বিষয়টি আয়ত্ত করতে হবে। এই দুনিয়াতে যেসব জঘন্য কাজ আছে তার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা বিপদগুলো কোন পথে আসে তা নিজেরাই জানে না। এই কারণে তস্কররা তাদেরকে সবার আগে শিকারে পরিণত করতে পারে।

ঘ) ডিজিটাল নিরাপত্তা : বস্তুত ডিজিটাল সুরক্ষার একটি সম্প্রসারিত দক্ষতা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা। ডিজিটাল সুরক্ষা যদি সুরক্ষা হয় তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা হচ্ছে ডিজিটাল প্রতিরক্ষা। এই দক্ষতার উদ্দেশ্য হলো ডিজিটাল বিপদে না পড়া এবং এমন বিপদে না পড়ার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা। এ জন্য সকল ধরনের প্রযুক্তিগত ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা টুল ব্যবহার করা।

ঙ) ডিজিটাল আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা : ডিজিটাল বিশ্বে বসবাস করে নিঃসঙ্গ থাকা যায় না। আবার ডিজিটাল বিশ্বে অতিরিক্তি আবেগের ব্যবহার চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফলে জানতে হবে কেমন করে ডিজিটাল বিশ্বে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যায় এবং খারাপ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকা যায়।

চ) ডিজিটাল যোগাযোগ : ডিজিটাল বিশ্বে বসবাস করে সকলের সঙ্গে সকল প্রকারের যোগাযোগ স্থাপন করা ও সকল ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারাটাও জরুরী। এ জন্য যোগাযোগের টুলসগুলো ব্যবহার করতে পারঙ্গম হতে হবে।

ছ) ডিজিটাল স্বাক্ষরতা : ডিজিটাল জগতে উপস্থিতি বজায় রাখার জন্যই এই যোগ্যতার দরকার। ডিজিটাল বিশ্বে খোজাখুজি করা, মূল্যায়ন করা, শেয়ার করা, উপাত্ত তৈরি করা এবং যৌক্তিক চিন্তাভাবনা দিয়ে ডিজিটাল বিশ্বে বসবাস করার দক্ষতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

জ) মেধাস্বত্ব সুরক্ষা ডিজিটাল বিশ্বে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকারগুলো সচেতনভাবে আয়ত্তে রাখতে হবে। বিশেষ করে ডিজিটাল বিশ্বে প্রধানত অর্জন হচ্ছে মেধাস্বত্ব। সবাইকে এই মেধাস্বত্ব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এর অধিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কেও জানতে হবে।

ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২০ ॥

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক

[email protected],

www.bijoyekushe.net.bd,

www.bijoydigital.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews