তৃপ্তির মধ্যে সব সময় লুকিয়ে থাকে আত্মঘাতের বীজ, অতৃপ্তি বরং উন্মুক্ত বাতায়ন পথে দৃশ্যমান করে তোলে সম্ভাবনার সহস্র সড়ক। সাকিব সেই সড়কেই হাঁটছেন এখন। তাড়িয়ে বেড়ানো একটি লক্ষ্য তাকে সারাক্ষণ বলে চলেছে- আরও একটু দূরে, আরও একটু দূরে যেতে হবে তোমাকে। বিশ্বকাপে সাকিবের এই পথে যে আসবে তাকেই মাড়িয়ে ছুটবে সে। কারও আস্ম্ফালন কিংবা হম্বিতম্বি থামাতে পারবে না সাকিব আল হাসানকে। থামাতে পারবে না তার দলকে। টাইগারদের ২৬২ রানে আটকে রাখার পর রোজ বোলের ডাইনিংয়ে যে ধারাভাষ্যকাররা আফগানপ্রীতি দেখাচ্ছিলেন, ৬২ রানে ম্যাচ হারার পর তারাই বলতে বাধ্য হলেন- 'সাকিব, দ্য ম্যাজিক অব বাংলাদেশ।' ৫ উইকেটের শিকারি। বিশ্বকাপে যে কোনো বাংলাদেশির জন্যই যা নতুন কোনো স্বাদ। তিন জয়ের তিনটিতেই ম্যাচসেরা তিনি, ৪৭৬ রান আর ১০ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপের 'টুর্নামেন্টসেরা'র জোর দাবিদারও তিনি।

হবে না-ই বা কেন, ১০ ওভারে ২৯ রানে ৫ উইকেট- এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোনো বোলারের এটাই সেরা স্পেল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের আমিরও ৫ উইকেট নিয়েছিলেন; কিন্তু তাকে খরচ করতে হয়েছিল ৩০ রান। শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়, এটা ছিল সাকিবের ক্যারিয়ারেরও সেরা বোলিং। এর আগে ৪৭ রানে ৫ উইকেট নেওয়া ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা তৃপ্তি। কিন্তু ওই সাকিবের ক্ষুধায় তৃপ্তি বলে কোনো কথা নেই। সাউদাম্পটনের রোজ বোলে 'সাকিব দিবস' দেখেছে এদিন  ক্রিকেটবিশ্ব।

তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনিই হয় হাওয়া বুঝে পাল তোলেন, কিংবা পরিস্থিতি বুঝে নোঙর ফেলেন। গতকাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে পালই তুলেছিলেন সাকিব। ২৩ রানের মধ্যে লিটন দাস ফিরে যাওয়ার পর তামিম ও মুশফিকের সঙ্গে জুটি বেঁধে দলের স্কোর এগিয়ে নিয়েছিলেন। আবার সতর্ক আফগানরা যখন উইকেট আগলে রেখে পাওয়ার প্লে শেষ করেছিলেন, তখন সাকিব এসেই উইকেট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। আফগানদের চোখের ভাষা পড়ে বুদ্ধি খাটিয়ে বোলিং করেছিলেন। আধুনিক ক্রিকেটে যার চলতি নাম 'স্মার্ট ক্রিকেট'। সাকিবের এই ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তা, মুশফিকের ক্যালকুলেটিভ ইনিংস আর মোসাদ্দেকের কলার তুলে বাউন্ডারি হাঁকানোর মধ্যেই আফগান-বধের সকল অস্ত্র মজুদ ছিল। ম্যাচের আগে আফগান অধিনায়ক গুলবাদিন নাইব নিজেদের 'ফেভারিট' বলে একটা উস্কানি দিতে চেয়েছিলেন টাইগারদের। বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে চেয়েছিলেন তারা।

কিন্তু তারা এখনও জানেন না, সেদিন চলে গেছে অনেক আগেই। এই বাংলাদেশ এখন চরম পেশাদার একটি দল। আবেগ তাদের ঠিকই স্পর্শ করে, কিন্তু সেটা তাদের চাপে ফেলে না। রশিদ খানরা জানেন না যে, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার দৌড়ে ভালোভাবেই টিকে আছে টাইগাররা। হাতে থাকা ভারত আর পাকিস্তানকে হারানোর মতো শারীরিক আর মানসিক শক্তি মজুদ করে রেখেছেন সাকিবরা। নিজেদের বাইরে অপেক্ষা করতে হবে শুধু ইংল্যান্ড যেন বাকি ম্যাচগুলোতে পা পিছলে পড়ে।

পা পিছলানোর চেষ্টা ছিল আফগানদেরও। সাকিব আউট হওয়ার পর প্রেসবক্সের বাইরে এসে কাবুল থেকে আসা এক সাংবাদিক ভিডিও কলে কথা বললেন মোহাম্মদ শাহজাদের সঙ্গে। ফোনটি রেখেই খুশি খুশি চেহারায় জানালেন- ও তো মনে করছে আড়াইশ' করলেই ম্যাচ আফগানিস্তানের। সাকিব আউট হওয়ার পর আফগানরা ধরেই নিয়েছিল, সেদিনের ভারত বানাব বাংলাদেশকে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুশফিকের ৮৩ রানের দায়িত্বভরা ইনিংস আর মোসাদ্দেকের ঝটপট তোলা ৩৫ রানে আড়াইশ' ছাপিয়ে টাইগারদের স্কোর ২৬২। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া আফগান ওপেনারের গণনার বাইরে বারোটি রান! শেষ পাঁচটি ওভারে ৩৫ রান, মোটের ওপর খুশিই ড্রেসিংরুম। আফগান স্পিনত্রয়ী মুজিব-নবি-রশিদের মঞ্চনাটকের পর তখন বাংলাদেশ স্পিনত্রয়ী সাকিব-মিরাজ-মোসাদ্দেকের ম্যাজিক দেখানোর অপেক্ষা। অবশ্য খুব বেশি অপেক্ষা করতেও হয়নি। নিজের প্রথম ওভারেই আফগান ওপেনার রহমতউল্লাহ শাহকে ফেরান সাকিব। স্পেল বদলে যখনই এসেছেন তুলে নিয়েছেন গুলবাদিন নাইব, মোহাম্মদ নবি, আজগর আফগান ও নজিবুল্লাহ জাদরানকে। একসময় তার ৪৯টি বলে মাত্র ১৫ রান নিতে পেরেছিলেন আফগান ব্যাটসম্যানরা। সারাক্ষণ নেটে যারা রশিদ খান আর মুজিবকে খেলেন, তারাই কি-না সাকিবের সামনে লেজেগোবরে অবস্থা!

আসলে দিনটিই ছিল সাকিবের। বিশ্বকাপে নিজের হাজার রান, মুশফিকের সঙ্গে জুটিতে তিন হাজার রান। সেই সঙ্গে ডেভিড ওয়ার্নারকে টপকে ফের আসরের শীর্ষ ৪৭৬ রানের মালিক। ফের পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস এই বিশ্বকাপে। আফগান স্পিন দারুণভাবে সামলে ইনিংস এগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। যদিও ৫১ রানে নয়, আরও বড় কিছু অপেক্ষা করেছিল তার জন্য। কিন্তু আফগান স্পিনার মুজিবের এলবিডব্লিউর আবেদনে আর রিভিউ নেননি তিনি। তার মনে হয়তো কোনো সন্দেহই ছিল না যে, বলটি স্টাম্পেই হিট করত। কিন্তু গভীর সন্দেহ ছিল লিটন দাসের আউটটি নিয়ে। স্পিনে সৌম্য অস্বস্তিতে ভোগেন, তাই কৌশল বদলে এদিন তামিমের সঙ্গে ফের ওপেনিং জুটি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল লিটনকে। যেভাবে তার শুরু হয়, সেভাবেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে গা গরমও করে নেন লিটন। কিন্তু মুজিবের বল চালাতে গিয়ে শর্ট কভারে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার হাসমতুল্লাহ শহিদির হাতে জমে যায় ক্যাচ। প্রচণ্ড গতিতে আসা বলটি আসলে থামাতেই চেয়েছিলেন; কিন্তু ফিল্ডারের হাতে আটকা পড়ে যায় তা। আম্পায়ার আউটই দিয়েছিলেন, তার পরও থার্ড আম্পায়ার আলিম দারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন রিপ্লেতে একবার দেখে নিতে। রিপ্লেতে কয়েকবার দেখে আম্পায়ার নিশ্চিত ছিলেন, বলের নিচেই হাত ছিল ফিল্ডারের, বল মাটিতে স্পর্শ করেনি। কিন্তু সেটা পুরোপুরি স্বচ্ছ ছিল বলে দাবি করা যাবে না। ফেসবুকে তখন থেকেই আগুন, ফিল্ডারের হাত মাটিতেই ছিল। সৌম্যর এলবিডব্লিউর সময়ও কেন আলট্রা এজ প্রযুক্তি দেখা হয়নি, সেটি নিয়েও বিতর্ক চলেছে।

অবশ্য ম্যাচটি শেষ হওয়ার পর আগুন থেমে গিয়েছিল ফেসবুকের। আলিম দারকে নিয়ে ট্রল করাও কমে গিয়েছিল, দমকলের মতো কাজ করেছিল সাকিবের পাঁচ উইকেট শিকার! হবে না-ই বা কেন, এর আগে কোনো বাংলাদেশি বোলার তো আর বিশ্বকাপে ৫ উইকেট শিকার করেননি। প্রেসবক্সের ব্রিটিশ স্কোরার যখন মাইক হাতে বলছিলেন 'সাকিব আল হাসান নাউ দ্য বেস্ট স্কোরার অ্যান্ড বেস্ট বোলিং ফিগার ইন দিস ওয়ার্ল্ড কাপ', তখন ভীষণ গর্ব হচ্ছিল।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews