বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে, যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আমাদের জনগণের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন বাঁচার তাগিদেই আমরা অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হই। সে সময় ভারত সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে সেটা তাদের কৌশলগত স্বার্থের অংশ ছিল। তবে এ সহায়তা ছিল ন্যায়সঙ্গত, কারণ আমরা জাতি হিসেবে আত্মনির্ধারণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছিলাম।

আজকের দিনে, একইরকম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বছরের পর বছর ধরে তারা জাতিগত নির্মূল, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং নাগরিকত্বহীনতার শিকার। তাদের পক্ষে কি আজ আত্মরক্ষা, আত্মনির্ভরতা, এমনকি আত্মনিয়ন্ত্রণের চিন্তা অবৈধ? আমাদের মতোই কি তারা একটি ন্যায়সঙ্গত পথের দাবিদার নয়?

স্বাধীনতা মানে শুধু ভূখণ্ড নয়

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ) যারা একসময় গোপন অস্তিত্বে থাকলেও এখন সরাসরি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক স্লোগান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ-

‘আরাকানবাসীদের ঐক্যই সব অগ্রাধিকারের মধ্যে সর্বোচ্চ। আজ আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো ঐক্যের সাহসিকতা প্রমাণ করা এবং সেই নৃশংস ও দমনমূলক স্বৈরশাসনের (মানে সামরিক জান্তা) অধীনে আর না থাকার সঙ্কল্প ঘোষণা করা, যারা আমাদের ভূমির জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সম্মানজনক বেঁচে থাকা আমাদের জাতির ন্যায্য অধিকার। আমরা, আরাকান আর্মি, এই মুক্তির পথে ঐক্যের দর্শনে অবিচল এবং আগামীকালের জন্য যে মূল্য দিতে হবে, তা আমরা দিতেই প্রস্তুত।’

এই ভাষ্য শুধু রাখাইন বৌদ্ধদের জন্য নয়, রোহিঙ্গাদের জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু আরাকান আর্মির আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক রূপরেখায় রোহিঙ্গাদের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। রোহিঙ্গাদের বাদ রেখে যদি ‘স্বাধীন আরাকান’ গঠনের কথা ভাবা হয়, তবে সেটি হবে আরেকটি একচেটিয়া জাতিগত শাসন, যা ভবিষ্যতে নতুন সংঘর্ষের জন্ম দেবে।

রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয়, স্বত্বাধিকারী

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুধু ‘শরণার্থী’ হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু ইতিহাস বলে, উত্তর আরাকান (বিশেষত মংডু, বুথিডং, রাথিডং) ছিল রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের বাসভূমি। ব্রিটিশ যুগ থেকে শুরু করে স্বাধীন বার্মার প্রথম দিকেও রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরি, শিক্ষা ও সেনাবাহিনীতে প্রতিনিধিত্ব পেতেন।

তাদের এভাবে বন্দী করে রাখার পেছনে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র কাজ করেছে। আজ যখন আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া-মিয়ানমার গণহত্যা মামলা চলছে, তখন আমাদের উচিত ত্রাণ বা মানবিক সহানুভূতির বাইরে গিয়ে ভাবা- রোহিঙ্গারা কিভাবে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগঠিত হতে পারে, তা নিয়েও।

রোহিঙ্গা আত্মরক্ষার অধিকার কি অবৈধ?

জাতিসঙ্ঘের (জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় চৎড়ঃবপঃ-(জ২চ) নীতিমালা অনুসারে, যদি কোনো রাষ্ট্র নিজ জনগণকে গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল বা মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই জনগণের আত্মরক্ষার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ। সে ক্ষেত্রে, রোহিঙ্গা ডিফেন্স ফোর্স (জউঋ) গঠনের মতো একটি প্রতিরক্ষা সংগঠনের চিন্তা অযৌক্তিক নয়।

এই বাহিনী আরাকান আর্মির সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে; বরং সমন্বিত প্রতিরোধ গঠন করতে পারে- সেনা জান্তার বিরুদ্ধে। একটি স্বায়ত্তশাসিত ও বহু-জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক আরাকানের স্বপ্ন দেখার অধিকার তাদের আছে। এতে এএ-এর ভাবমর্যাদাও আন্তর্জাতিক মহলে আরো গ্রহণযোগ্য হবে এবং রোহিঙ্গারা পাবে মর্যাদার ভিত্তিতে ফিরে যাওয়ার বাস্তব সুযোগ।

আত্মরক্ষা, সহাবস্থান ও আধা স্বায়ত্তশাসনের কৌশলগত প্রস্তাব

রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র নয়; বরং রাখাইন রাজ্যের মধ্যেই একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক কাঠামো গঠন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত প্রায় স্বাধীন অঞ্চলের নাম বলা যায়।

ইরাকি কুর্দিস্তান : যাদের নিজস্ব সংসদ, নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসন নিয়ে কার্যত স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রভুক্ত।

বুগেইনভিল (পাপুয়া নিউগিনি) : স্বায়ত্তশাসনের অধীনে শান্তি ও স্বতন্ত্রতা অর্জনের পথে।

তিব্বত (চীন) : সীমিত স্বায়ত্তশাসন সত্তে¡ও সাংস্কৃতিক অধিকার টিকে আছে।

এই মডেলগুলো দেখায়, একটি বহুজাতিগোষ্ঠীর দেশে সাম্য ও সহাবস্থানের জন্য স্বায়ত্তশাসন একটি কার্যকর ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে।

বাংলাদেশের ভূমিকায় কৌশল, আবেগ নয়

বাংলাদেশকে অবশ্যই আবেগ নয়, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে হবে। কিছু প্রস্তাব :

নীরব কূটনৈতিক সহায়তা : প্রকাশ্য নয় কিন্তু গোপনে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার সুযোগ সৃষ্টি করা।

মানবসম্পদ উন্নয়ন : কক্সবাজারে বসবাসকারী তরুণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকাশ ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ দেয়া।

তথ্যযুদ্ধ ও সাইবার সক্ষমতা : ভারত বা মিয়ানমারের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সত্যিকারের ছবি তুলে ধরতে তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারে সহায়তা।

আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে প্রচার : ওআইসি, সার্ক, আসিয়ান, এমনকি চীন ও রাশিয়ার সাথে বৈঠকে রোহিঙ্গা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষের যুক্তি তুলে ধরা।

এই নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজ সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়াতে পারবে এবং ভবিষ্যতে নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি হ্রাস পাবে।

ইতিহাসের আলোকচ্ছটা

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রবেশ এবং বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব- এগুলো এক সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফল, যেখানে সামরিক বাহিনী নিজেদের জাতির একমাত্র রক্ষক হিসেবে কল্পনা করে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে উত্তর আরাকানে রোহিঙ্গা মুজাহিদিন আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এ ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবেই সচেতন ছিল এবং এই সম্ভাবনাকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। ফলে বাংলাদেশ সরকার কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সামরিক হুমকি না দিলেও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ গোষ্ঠী গঠনের সম্ভাব্য ইঙ্গিতই সম্ভবত সামরিক জান্তাকে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে বাধ্য করে।

ভারত, চীন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। ভারত রাখাইন অঞ্চলে সড়ক ও বন্দর নির্মাণে আগ্রহী, আর চীন মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্বায়ত্তশাসন যদি জান্তার বিকল্প হিসেবে গৃহীত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে চীনেরও লাভ হতে পারে- কারণ, তারা জান্তা সরকারের দায়ভার থেকে মুক্তি পাবে এবং শান্তি উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

প্রতিরোধের ভেতরেই মুক্তির বীজ

রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি দীর্ঘকালীন জাতিগত নিপীড়ন ও রাজনৈতিক বঞ্চনার ফল। এই সঙ্কটের টেকসই সমাধান কেবল রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই সম্ভব।

ইতিহাস বলে, প্রতিরোধের মধ্যেই মুক্তির বীজ নিহিত থাকে। এই প্রতিরোধ যদি সুসংগঠিত ও ন্যায়ভিত্তিক হয়, তবে তা ভবিষ্যতের শান্তি ও সহাবস্থানের পথও খুলে দিতে পারে। যদি আরাকান আর্মি সত্যিই ‘ঐক্য’ এবং ‘স্বায়ত্তশাসন’-এর পতাকা তুলে ধরে, তাহলে সেই ঐক্যে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করাই হবে তাদের সবচেয়ে সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অন্যথায়, রাখাইনের ইতিহাস আবারো রক্তাক্ত হবে- আর সেই রক্তের ভার বহন করতে হবে বাংলাদেশকেই, আগামী অনেক বছর ধরে। সমস্যা বড় হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলে, বড় সমাধানও বড় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ- উপাচার্য, বিইউপি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews