‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ কবি শামসুর রাহমানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। বইঘর, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় ১৩৭৩ বাংলায়।
কাইয়ুম চৌধুরী কৃত নীল মলাটের ৯০ পৃষ্ঠার বইটির প্রথম প্রকাশকালে (১৯৬৬ সালে) দাম ধরা হয়েছিল তিন টাকা। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে আমার বন্ধুত্ব হয় কবিতাপাগল পলোগ্রাউন্ড নিবাসী আ জ ম আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে। সে বন্ধুটি আমার হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার কাছ থেকে ধারে নেওয়া বা মেরে দেওয়া বইটি আমার কাছে এখনো আছে। জোহরাকে উৎসর্গকৃত বইটি আমাকে সে সময় শামসুরের একান্ত ভক্ত করে ফেলেছিল। ‘যেতে চাই, আকৈশোর মগ্নতায়, অতি সন্তর্পণে/স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে/কবিতার অন্তঃপুরে যেতে চাই। ’ শামসুরের চিত্রকল্প তখনই বিরাটভাবে আমাকে আকর্ষণ করে। ‘ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ/ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে’—‘জনৈক সহিসের ছেলে বলছে’ শীর্ষক এ কবিতাটির সঙ্গে আরেকটি কবিতার আরেকটি চিত্রকল্প মনে পড়ছে : ‘যেন সে ঝড়ের রাতের রাজা উন্মত্ত লীয়ার। ’
শামসুর রাহমানের পরিচয় কিন্তু ভিন্ন। আধুনিক কবিদের অভিভাবক ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রতি’ পরবর্তীকালে তিনি অপার মুগ্ধতায় লিখলেন বটে ‘শব্দে আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়/আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম,’ কিন্তু এর বহু আগে কলাকৈবল্যবাদী দর্শন ছেড়ে তিনি নেমে পড়েছেন কবিতাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে।
কবিতা তাঁর কাছে আর শুধু শব্দের বেসাতি হয়ে রইল না, কবিতা হয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনন্য কথক—সমাজবদলের হাতিয়ার। গুলিটা লাগল যেন আসাদের বুকে নয়, শামসুরের ‘আসাদের শার্ট’-এর মারফতে সারা বাঙালি জাতি বুঝে গেল গুলিটা আসলে লেগেছিল বাংলাদেশের বুকে—যে বাংলাদেশের তখনো জন্ম হয়নি। নিজ বাসভূমে বইটিতে গ্রন্থিত ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি সংঘটিত গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের ওপর লেখা কবিতাটির প্রথম স্তবক—‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিম্বা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়। ’ এই কবিতাটিতে বোন আছে, জননী আছে, ডালিমগাছ আছে, আর অমোঘভাবে ফুটে উঠল এ সত্য যে ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। ’ এ পর্যায়ে শামসুরের কবিতা আর বাংলাদেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস একটি আরেকটির পরিপূরক। শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থগুলোর শিরোনামে একের পর এক এরই প্রতিফলন হলো : বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে এবং কিছুটা স্বপ্নগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ গ্রন্থটি। বায়ান্নোর আর্তি ফুটিয়ে তুললেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায়, আর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখলেন, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ শীর্ষক অনন্য কবিতাটি। এর পরের কবিতাটি ‘স্বাধীনতা তুমি’ সমগ্র বাংলা কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত একটি ঝলক: ‘স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। /স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ...। ’কবিতা তাঁর কাছে আর শুধু শব্দের বেসাতি হয়ে রইল না, কবিতা হয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনন্য কথক—সমাজবদলের হাতিয়ার। গুলিটা লাগল যেন আসাদের বুকে নয়, শামসুরের ‘আসাদের শার্ট’-এর মারফতে সারা বাঙালি জাতি বুঝে গেল গুলিটা আসলে লেগেছিল বাংলাদেশের বুকে—যে বাংলাদেশের তখনো জন্ম হয়নি। নিজ বাসভূমে বইটিতে গ্রন্থিত ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি সংঘটিত গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের ওপর লেখা কবিতাটির প্রথম স্তবক—‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিম্বা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়। ’ এই কবিতাটিতে বোন আছে, জননী আছে, ডালিমগাছ আছে, আর অমোঘভাবে ফুটে উঠল এ সত্য যে ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। ’ এ পর্যায়ে শামসুরের কবিতা আর বাংলাদেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস একটি আরেকটির পরিপূরক। শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থগুলোর শিরোনামে একের পর এক এরই প্রতিফলন হলো : বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে এবং কিছুটা স্বপ্নগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ গ্রন্থটি। বায়ান্নোর আর্তি ফুটিয়ে তুললেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায়, আর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখলেন, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ শীর্ষক অনন্য কবিতাটি। এর পরের কবিতাটি ‘স্বাধীনতা তুমি’ সমগ্র বাংলা কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত একটি ঝলক: ‘স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। /স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ...। ’
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের পথিকৃৎ কবি। একজন সুশিক্ষিত কবিও। তাঁর কবিতায় ইংরেজ কবিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় কবির প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। একটা কাব্যগ্রন্থের নাম, ইকারুসের আকাশ। টেনিসনের ‘ইউলিসিস’ কবিতার প্রত্যুত্তর যেন তাঁর ‘টেলেমেকাস’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটি। রাতের বেলায় প্রেমিকার জানালার নিচে বসে তার মনোযোগ আকর্ষণ করে প্রেমিক যে যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করে সেটির নাম সেরিনিদ, এবং এ স্প্যানিশ শব্দটি আমি প্রথম শামসুর রাহমানের কবিতায় পাই। এ প্রসঙ্গে বলি, শামসুর রাহমান অনূদিত শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকটি অত্যন্ত যথার্থ ও কুশলী অনুবাদ। ‘টু বি অর নট টু বি’ একটি বিখ্যাত স্বগতোক্তিমূলক বয়ান, এবং এটির কাব্যাশ্রিত গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাগুলো শামসুর আশ্চর্য দক্ষতায় অনুবাদ করেছেন।
শামসুর রাহমানের কবিতায় তিনটি জিনিস আমি পাই। একটি হলো গল্প বলার ঢং। তাঁর প্রায় কবিতাকে সরল গদ্যে গল্পের মতো টেনে লেখা যায়। কাহিনি আছে, সে কাহিনি বলার মধ্যে কাব্যময়তাও আছে। আরেকটি হলো তাঁর তালিকা তৈরি করার প্রবণতা, ইংরেজি কাব্য সমালোচনায় যাঁকে ক্যাটালগিং বলে। বিশেষ করে তাঁর দেশমাতৃকার ওপর লেখা কবিতাগুলো প্রণয়নকৃত তালিকাঋদ্ধ : ‘ঝাঁকা-মুটে, ভিখিরী, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,/শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক...। ’ ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ শীর্ষক কবিতাটি সম্ভবত রূপক অর্থে মওলানা ভাসানীর ওপর রচিত—তা থেকে উদাহরণ টানলাম। এ কবিতাটিতে একটু বেশি, কিন্তু অন্য কবিতাগুলোতে এতটা না হলেও তাঁর তালিকা প্রণয়নের অভ্যাস লক্ষ করা যায়। তাঁর তৃতীয় জিনিসটি হলো তুলনা দিয়ে চিত্রকল্প তৈরি করা। দু-একটি উদাহরণ আগেই দিয়েছি, কিন্তু তাঁর কাব্যভাষার এটি প্রধান প্রকরণ।
তাঁকে হুমায়ুন আজাদ ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ বলেছিলেন। কিন্তু শামসুর রাহমান ঠিক জীবনানন্দ ধাঁচের নিঃসঙ্গতা কবিতায় আনেননি, বরঞ্চ পারিবারিক মায়ার একটি প্রলম্বিত ছায়া তাঁর কবিতায় টানা আছে। জীবনবোধ ও দর্শনে জীবনানন্দের মতো মৌলিক তিনি হয়তো ছিলেন না, কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো শাশ্বত কাব্যশক্তি হয়তো তাঁর ছিল না, কিংবা আল মাহমুদের মতো কাব্যকথনের আচমকা মোচড় তাঁর কবিতায় পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু বাঙালি রাজনীতিসচেতন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নাগরিক জীবনের মূল্যবোধের শিকড়ের ঠিকুজি শামসুর রাহমানের কবিতায় একান্তভাবে পাওয়া যায়। জীবনভর মধ্যবিত্তের দিন কালাতিপাত হয় বঞ্চনা আর বিপর্যস্ততার মধ্যে, থাকে স্বপ্নভঙ্গ আর সব হারানোর বেদনা।
তার পরও কবির সঙ্গে আমরা ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ [আমাদের] এক ধরনের অহংকার’।
লেখক: অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক