বর্জ্য রিসাইক্লিং সাফল্যে এখন আর আবর্জনাই পাচ্ছে না চীন
‘আবর্জনা ফুরিয়ে যাচ্ছে চীনে!’ দেশটি এত দক্ষভাবে আবর্জনা রিসাইকেল করেছে যে, এখন তাদের কাছে পর্যাপ্ত আবর্জনাই নেই।
সম্প্রতি ‘হাংরি ইনসিনারেটর’ বিষয়টি চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব আলোচিত হচ্ছে। ‘হাংরি ইনসিনারেটর’ বলতে বোঝায় চীনে যেসব প্ল্যান্ট বা কারখানা আবর্জনা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ বা জ্বালানি তৈরি করছে তারা এখন পর্যাপ্ত আবর্জনা পাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে লিখেছে চীনা পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস।
এসব ইনসিনারেটর এতটাই আবর্জনার অভাবে রয়েছে যে, স্থানীয় আবর্জনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, এমনকি বিদেশ থেকেও বর্জ্য আমদানি করছে তারা।
‘সিনহুয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ এনভায়রনমেন্ট’-এর অধ্যাপক লিউ জিয়াংগুও দেশটির সংবাদমাধ্যম ‘চায়না নিউজ নেটওয়ার্ক’কে বলেছেন, চীনের অনেক শহরে দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনার পাহাড় জমে থাকার যে সমস্যা ছিল, সেই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য ইনসিনারেশন পদ্ধতির দ্রুত বিস্তার।
লিউ বলেছেন, সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে চীনের আবর্জনা পোড়ানোর শিল্প বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়।
‘ইনসাইট অ্যান্ড ইনফো’র প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চীনে এক হাজার ১০টি বর্জ্য পোড়ানোর প্রতিষ্ঠান হয়েছে, যা সারা বিশ্বের মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
হাইনান চীনের প্রথম প্রদেশ, যেখানে পুরো প্রদেশজুড়ে আবর্জনা পুড়িয়ে জ্বালানি উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করেছে দেশটি। চীনের সানিয়া শহরে মাঠপর্যায়ের এক সফরের সময় চায়না নিউজ নেটওয়ার্কের সাংবাদিকরা দেখেছেন, শহরটির পৌরসভা বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনকারী কারখানায় বদ্ধ এক বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য সাইলো রয়েছে, যেখানে ২০ হাজার মেট্রিক টন আবর্জনা রাখা যায়।
সানিয়ার ওই কারখানায় প্রতি মেট্রিক টন আবর্জনা থেকে ঘণ্টায় প্রায় তিনশ ৪০ থেকে সাড়ে তিনশ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, যা একটি পরিবারের এক মাসের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। সহজ করে বললে, পাঁচটি পরিবারের উৎপাদিত আবর্জনা দিয়ে একটি পরিবারের পুরো মাসের বিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব।
স্মার্ট বা ইন্টেলিজেন্ট বর্জ্য পোড়ানোর বিভিন্ন কারখানা চীনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা অনেক বাড়িয়েছে এবং পরিবেশবান্ধব বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনের পদ্ধতি এখন দেশে দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
চীনের পরিবেশ বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ২০২৪ সালের ‘চায়না ইকোলজিক্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্ট্যাটাস বুলেটিন’-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে চীনা শহরের ঘরবাড়ির আবর্জনা সংগ্রহের পরিমাণ পৌঁছেছে ২৬ কোটি ২৩ লাখ মেট্রিক টনে, যেখানে পরিবেশের ক্ষতি না করে চীনের নিরাপদে বর্জ্যকে শোধনের সক্ষমতা রয়েছে প্রতিদিন প্রায় ১১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন।
এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, এরইমধ্যে নিজেদের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারিত সময়ের আগেই পেরোতে পেরেছে চীন। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দেশটির শহুরে ঘরবাড়ির আবর্জনা পোড়ানোর সক্ষমতা প্রতিদিন প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছাবে।

তবে চীনের বর্জ্য শোধন সক্ষমতা এখন সংগৃহীত বর্জ্যের পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের বিভিন্ন ইনসিনারেশন কারখানা নিজেদের যতটা সক্ষমতা সে পরিমাণ কাজ করতে পারছে না।
বেইজিংভিত্তিক আধাসরকারি থিংক ট্যাংক ‘ই২০ ইনস্টিটিউট’-এর মতে, চীনের বর্জ্য পোড়ানোর বিভিন্ন কারখানার ব্যবহৃত সক্ষমতা কেবল ৬০ শতাংশ। ফলে ৪০ শতাংশ সক্ষমতা ফাঁকা পড়ে আছে। অনেক কারখানা এখন ‘আবর্জনা সংগ্রহ’ শুরু করছে, এমনকি কিছু কারখানা ২০ বছর আগে মাটিতে পুঁতে রাখা পুরানো আবর্জনাও গর্ত খুড়ে বের করছে।
স্বল্পমেয়াদে বিভিন্ন ইনসিনারেশন কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখতে হলে আরও বেশি বর্জ্য প্রয়োজন।
লিউ বলেছেন, ইনসিনারেশন পদ্ধতিকে আরও বিস্তৃত করা উচিত, যাতে এটি অন্যান্য ধরনের বর্জ্যও সংগ্রহ পারে। যেমন– গ্রামীণ গৃহস্থালির আবর্জনা, দাহ্য শিল্পের বর্জ্য এবং আগে সঠিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন জৈব বর্জ্য।
চীনের কিছু কোম্পানি বিদেশ থেকেও বর্জ্যের সরবরাহ খুঁজছে। কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশে বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনের প্রকল্প শুরু করেছে, যেখানে তারা কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় নয়, বরং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশেও বিনিয়োগ ও পার্টনারশিপ করছে।
চীনের বর্জ্য পোড়ানোর যেসব কারখানা আগে বর্জ্য ঘাটতিতে ছিল এখন তারা আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী রপ্তানিকারক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে, যা চীনের পরিবেশবান্ধব সভ্যতা গড়ার প্রচেষ্টায় বড় এক শিল্প অগ্রগতির ইঙ্গিত। বিদেশে রপ্তানি করা ইনসিনারেশন প্রযুক্তি কেবল যন্ত্রপাতি নয়, বরং এটি চীনের পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের জন্যও বড় সাফল্য।