চলমান তাপদাহ থেকে শিগগিরই মুক্তির কোনো আভাস নেই। তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে আভাস দিয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া অফিস। গত ক’দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ তাপদাহ থেকে মুক্তি ও বৃষ্টি চেয়ে ইস্তিসকার নামাজ ও বিশেষ দোয়া মোনাজাত করছে। মোনাজাতে আমিন আমিন বলে চোখের পানি ফেলছে। এটাই বাস্তবতা। বিপদে পড়লে, দুনিয়ায় কোনো ভরসা না দেখলে নাস্তিক স্বভাবের মানুষও আল্লাহর নাম জপে, তার কাছে ফরিয়াদ করে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু উত্তরাঞ্চল বা বাংলাদেশ নয়, ‘এল নিনোর’ প্রভাবে এ বছর ভারত ও আরব মহাসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তাপের এ দাপট। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি গাছ কাটা ও অপরিকল্পিত নগরায়নও তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।

সাধারণ মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানের এতো ফের বোঝা সম্ভব না হলেও বিষয়টি মোটামুটি বোধগম্য। গরমের তাড়না কম-বেশি সবার গায়েই লাগছে। বৃষ্টির জন্য চারদিকে হাহাকারও দৃশ্যমান। গোটা দেশে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক কর্মচঞ্চলতা। ফসলি জমি শুকিয়ে গেছে। এর জেরে ধানসহ আম ও লিচুর ফলন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এই দাবদাহ আর অনাবৃষ্টি চিরকালই এক অভিশাপ। চৈত্র ও বৈশাখের প্রচ- খরতাপে ফসলের মাঠ হয়ে উঠত বিবর্ণ। সব জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানি জোগাড় করাও হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য। এজন্য গ্রাম বাংলার মানুষ অপেক্ষা করে বৃষ্টির।

পৃথিবীর পানীয় পানি, কাদামাটি, নদনদী সবই প্রি মেইড। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার ধ্বংস নেই, আছে রূপান্তর। পানি জমে বরফ হয়। আর পুড়ে হয় বাষ্প। এই রূপান্তরেই পূর্বনির্মিত গঠন প্রণালীর উপর চলছে প্রকৃতি, প্রকৃতির বাসিন্দা, জড় ও জীব জগৎ। জগতের অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে মানব দেহের গঠন শৈলী এবং তাঁর চমৎকারিত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মানুষের দেহে যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে তাইই আছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এমন কিছু নেই যার প্রয়োজন অনাবশ্যক। প্রয়োজনের তাগিদে মূলকে ঠিক রেখে বাড়তি অংশ কেটে বা ছেঁটে দিলে সুবিধা বই অসুবিধা হয় না। কিন্তু মূল অংশে কিঞ্চিত অযাচিত হস্তক্ষেপ হলে বিপর্যয় অনিবার্য। যেমন পায়ের আঙ্গুলের নখের বাড়তি অংশের চেয়ে এক জাররা বেশি কাটলেই আঙ্গুল অরক্ষিত হয়ে যায়। অরক্ষিত অংশের জ্বালা এবং যন্ত্রণা পুরা মানব দেহকে অস্থির করে তোলে। ঠিক একই ভাবে পাহাড়, নদী, গাছপালা, মাটি, সমুদ্র সমুহের উপর এবং নিচ সবই প্রকৃতির প্রয়োজনে সৃজিত। তাই বলে প্রকৃতি থেকে মানুষ যে কোন কিছু নিতে পারবে না তা নয়। মানুষের যা প্রয়োজন প্রকৃতিতে থেকে মানুষ অবশ্যই তা সংগ্রহ করবে। তবে প্রকৃতির নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে প্রকৃতির প্রায় সকল সিস্টেমের গায়েই মানুষ দুঃখজনকভাবে হাত দিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে নানা রকমের বিপর্যয়। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কিছুদিন ধরে নতুন করে চলছে প্রকৃতিকে গালমন্দ করা। যত দোষ প্রকৃতির ঘাড়ে চাপানো। প্রকৃতি খারাপ হয়ে গেছে, ক্ষেপে গেছে, চ-াল হয়ে গেছেসহ কত ধরনের দোষারোপ। খরা-বন্যা, রোদ-বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা অতি ঘটনায় মানুষ প্রকৃতিকে গালমন্দ করছে। প্রকৃতির স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে বলে কথা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি মানবসৃষ্ট নয়। মানুষ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি বলতে এই পৃথিবী তথা গোটা সৃষ্টি জগৎকে নির্দেশ করে। প্রকৃতি জীবন্ত, বিপুল শক্তিশালী, চলমান সত্তা। মানুষসহ প্রাণিকুল বেঁচে থাকছে প্রকৃতির দয়ায়-ছায়ায়। এই প্রকৃতি যে সাম্প্রতিককালে রুক্ষ-মহাক্ষেপাটে তা প্রকাশ্যেই। এখানে লুকোচুরি বা আড়াল করার কিছু নেই।

প্রকৃতির সর্বনাশের আসল হোতা মানুষের ক্রিয়াকর্ম। বিকল্প ব্যবস্থা থাকার পরও তারা শিল্পের বর্জ্যের বিষ বাতাসে ছেড়ে, পাহাড়, বন, গাছপালা কেটে সাফ করে। বিশ্বময় অস্ত্র, গোলা-বারুদে প্রকৃতিকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা- প্রতিজ্ঞা নিয়েই এগিয়েছে মানব সভ্যতা। জয় করা আর অবিচার করা এক নয়। জয় আর অবিচার গুলিয়ে ফেলায় প্রকৃতিকে মানুষের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এর অনিবার্যতায় খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার সংকট কম-বেশি গোটা বিশ্বেই। নিরপেক্ষ-নির্দোষ প্রকৃতিও বেদরদি হয়ে উঠছে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মানুষের। কিন্তু তাদের নানা কর্মকা- ও সভ্যতার বিকাশের নামে প্রতিনিয়ত আঘাত পড়ছে প্রকৃতির ঘাড়-মাথায়। এতে প্রকৃতির বিগড়াতে বা মাইন্ড করতে কি সময় লাগে? দেশে প্রকৃতি নিয়ে কথা বলা, কাজ করার লোকও কম। পরিবর্তন প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলেও এর ফল সব সময় খারাপ হয় না। কখনো কখনো ভালো কিছুও হয়। প্রকৃতির সব পরিবর্তন সব সময় মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে হয় না। দৃষ্টি ও জ্ঞানের অলক্ষ্যে ঘটা ওই পরিবর্তনের ফল সব সময় জানা হয় না। ওই পরিবর্তনের সুফল-কুফলও থেকে যায় জানার বাইরে।

গবেষকরা বলছেন, গত ১০ বছরে বিশ্বে যত বন্যা, ঝড় ও দাবানল হয়েছে তার সবই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে। বাংলাদেশের প্রকৃতি এর বেশি শিকার। অসময়ে বৃষ্টি, বৃষ্টির মৌসুমে খরা, এক এলাকায় বৃষ্টি, আরেক এলাকায় খরা। শীতকালেও শীতের দেখা মেলে না। প্রকৃতির যথানিয়মের এই খেয়ালের মাঝে তাপদাহে পুড়ছে মানুষ। তারওপর মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের ঘনঘটা। বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিং মোটেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। বৈরী আবহাওয়া ও অসহ্য গরমে জনজীবনে যখন ত্রাহী অবস্থা চলছে, তখনই শুরু হয়েছে বিদ্যুতের এই ভয়াবহ লোড শেডিং। দিনে-রাতে যখন-তখন বিদ্যুৎ যাওয়া আসার খেলায় মেতেছে। সেচের অভাবে ধানক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে, আমের মুকুল ঝড়ে যাচ্ছে, বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি উৎপাদন। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় কলকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে, কোলরেস্টরেজে পঁচে যাচ্ছে কৃষিপণ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্যান না চলায় তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রিক মানুষের জীবন। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজে নষ্ট হচ্ছে খাদ্যপণ্য। তীব্র গরমের মধ্যে টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার যন্ত্রণায় নগরের চেয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ। মানবসৃষ্ট এ যাতনায় সারাদেশের মানুষের ত্রাহি দশা। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার থেকে কেন্দ্রে হামলা, মিছিল বের করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

তাপদাহের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকার বিষয়ে কোনো আশার খবর না দিয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জানিয়েছেন, তাপদাহ কমে গেলে লোডশেডিং স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অথচ, দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যাপক সাফল্য দেখানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডের তথ্যও জানানো হচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়ে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews